Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

প্রকৃতই তাই।দেবী সরস্বতীর চরণ ছুঁয়ে সারাজীবন বিভোর হয়েছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।হাওড়ার সালকিয়ার এক বনেদীবাড়ির গৃহকর্তা এই মানুষটি বাংলা আধুনিক গান ও ছায়াছবির গানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের সৃষ্টির হীরকদ্যুতি।বাংলা এবং বম্বের এমন কোনও শিল্পী নেই যিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় গান করেন নি।
পিতা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের চিত্রতারকা।পুত্র পুলক পাঠ নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি।কিন্তু সেসব কোনোপথেই হাঁটলেন না মানুষটি।জামাইবাবু সরোজ মুখার্জি ছিলেন প্রযোজক। তাঁর প্রযোজনায় ১৯৪৯ সালে মুক্রিপ্রাপ্ত অভিমান ছবিতে গান লিখলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।সুরকার রামচন্দ্র পাল।শুরু হলো বাংলা সিনেমায় ও আধুনিক গানে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়যাত্রা
কিন্তু শুধুমাত্র গান লিখেই ক্ষান্ত হননি তিনি।’প্রান্তরেখা’,’ রাগ অনুরাগ’,’নন্দিতা’,’ হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ,’ ‘ বন্দী বলাকা’,ইত্যাদি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন।লিখেছেন নানাধরনের কবিতা ও ছড়া।৫০ বছর ধরে বহু গান রচনার মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।সেসব গান আজও মানুষের মনে অনুরণিত হয়ে চলেছে।বেশ কিছু গান তৈরির গল্প তো বেশ চিত্তাকর্ষক।
‘ তিন ভুবনের পারে’ ছবির কাজ চলছে।সুরকার সুধীন দাসগুপ্ত। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি গান লিখলেন ‘ কোনও এক চেনা পথে যেতে যেতে একদিন পথ বলে অরণ্যে যাব’। গান লেখা শেষ হলে সুধীন দাসগুপ্ত বললেন

  • আজ থাক।কাল একটা এক্সপেরিমেন্টাল গান নিয়ে বসবো আপনার সঙ্গে।
    কি সেই এক্সপেরিমেন্টাল গান হবে সেই নিয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।কিন্তু কিছু লেখা হলো না।পরের দিন দুজনে স্টুডিওতে গেলেন দুজনে।’ সাউন্ড অন সাউন্ড’ এর ওপর সুধীন দাসগুপ্ত গান লিখতে বললেন পুলককে।এক বিশেষ যান্ত্রিক মিক্সিং এর ওপর লিখতে হবে পুলক লিখলেন ‘ দূরে দূরে কাছে কাছে এখানে ওখানে কে ডাকে আমায়’। প্রথম ‘দূরে দূরে’ র প্রতিধ্বনিত হলো দূরে দূরে আবার প্রথম ‘ কাছে কাছে’ র পর প্রতিধ্বনিত হলো ‘ কাছে কাছে’।বাংলা বা ভারতবর্ষে এরকম গান আগে হয়নি।কলকাতার টেকনিসিয়ান স্টুডিওতে সত্যেন চট্টোপাধ্যায় অপূর্ব রেকর্ডিং করলেন।সেই গানের জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।
    সলিল দত্ত পরিচালিত স্ত্রী ছবির গান হচ্ছে।সুরকার নচিকেতা ঘোষ। একদিন সন্ধ্যায় একটি গান তৈরি করে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালকের বাড়ি গেলেন।সবাই গানের কথা শুনে গানটিকে মনোনীত করলেন। রাতে গাড়ি চালাতে চালাতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাড়ি ফিরছেন তখন তাঁর মনে হলো যে গানটি বোধহয় ঠিক হলো না।অনেক রাতে বাড়ি ফিরে তাঁর বাড়ি সালকিয়া হাউসের প্রতি করুণ চোখে তাকালেন পুলক। মনে হলো এই বাড়ির ঝাড়লন্ঠন যেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে।কেমন যেন এক অনুভূতি হলো ইঁট -কাঠ- মার্বেলে বন্দী এই বাড়ির বাসিন্দাদের প্রতিও।অত রাতেই তিনি লিখে ফেললেন
    ‘ খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী’
    স্ত্রী ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইলেন সেই গান।
    এই নচিকেতা ঘোষই আরতি মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গানে সুর করবেন।বম্বেতে থাকার সময় নচিকেতা ঘোষ একটি গানে সুর করেছিলেন ‘ আজা ও মেরি’। সুরটা ভারি সুন্দর। সেই সুর শুনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘ লজ্জা মরি মরি একি লজ্জা’। এবার উলটো পিঠের গান।পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় স্টিমারে করে সালকিয়ার বাঁধাঘাট থেকে আহিরীটোলার ঘাটে আসতেন উত্তর কলকাতায় নচিকেতা ঘোষের বাড়ি যাওয়ার জন্য।সেদিন ফেরবার সময় আহিরীটোলার ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বাড়ি ফেরবার জন্য। দেখলেন এক জায়গায় লেখা আছে ‘সাবধান, গভীর জল’।স্টিমারে আসতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। বাড়ি ফেরবার সময় সেই স্টিমারে বসেই লিখে ফেললেন ‘জলে নেমো না আর থই পাবে না’।পুজোর সময় প্রকাশিত সেই গান আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান আরও কিছুটা আলোকিত করেছিলো।
    ভবানীপুরে টার্ফ রোডে তখন থাকেন অখিলবন্ধু ঘোষ। সারা ভবানীপুর আলো ঝলমলে কিন্তু অখিলবন্ধু ঘোষের বাড়ি অন্ধকার। ইলেকট্রিক বিল সময়মতো না দেওয়ার জন্য বাড়িতে আলো নেই।ঘরে ঢুকে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেন যে ঘরটা ধূপের গন্ধে ম ম করছে। তিনি একটা মাদুরে বসলেন।ঘরটা সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি।একটা মোমবাতি জ্বলছে ঘরে।কেদারা রাগে একখানি গান অখিলবন্ধু গাইছেন।একজন তবলা বাজাচ্ছেন।ঘরে অনেক ছাত্রছাত্রী রয়েছে।গান শেষ করে অখিলবন্ধু তাকালেন।যিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এসেছিলেন তিনি অখিলবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করালেন।
  • লিখুন তো একখানা গান।কেদারা দিয়ে শুরু করবো তারপর আনবো বসন্ত বা বাহার।আইডিয়াটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।লিখুন লিখুন চুপ করে বসে আছেন কেন? কাল বালিগঞ্জে বম্বে থেকে অশোককুমার ফাংশান করতে আসবেন।উনি নিজে আমাকে ডেকেছেন ওখানে।এই গানটা গাইবো। – অখিলবন্ধু বললেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
    একঘর লোক। টিমটিমে আলো।লিখে ফেললেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
    ‘ আজি চাঁদনি রাতি গো
    মালাখানি গাঁথি গো
    ফিরে যেয়ো না যেয়ো না’
    সেই গান অখিলবন্ধু গাইলেন বালিগঞ্জের অনুষ্ঠানে।গায়ক নায়ক অশোককুমার সেই গান শুনে গোলাপফুল দিয়ে অভিনন্দন জানালেন অখিলবন্ধুকে।
    মনে আছে এফ এমের আজ রাতের এক আসরে শ্রীমতী মধুমিতা বসু অতিথি করে এনেছিলেন শ্রী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।ফোনে কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো সেদিন।আবিষ্কার করেছিলাম মজলিশি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।দূরদর্শনে মান্না দে,সুপ্রভা সরকার, সনৎ সিংহর সঙ্গে কথায় ও সুরেতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা একমত হবেন আমার সঙ্গে।
    ১৯৯৮ সালে পুজোর সময় মান্না দে গাইলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘ আমায় একটু জায়গা দাও’,’ বা যখন এমন হয় জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা’,শ্রোতারা মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন।’ আমি দুচোখ ভরে ‘,’ বড়ো ময়লা জমেছে মনে’,’ মা মা গো মা’,ইত্যাদি গানগুলি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর মান্না দের জুটির সেই ম্যাজিক কে যেন আবার ফিরিয়ে দিলো শ্রোতাদের কাছে।তার পরের বছর ১৯৯৯ এর সেপ্টেম্বরে চিরতরে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
    পেয়েছেন সরকারি পুরস্কার,বিএফজে এওয়ার্ড,উত্তমকুমার পুরস্কার,শিরোমণি পুরস্কার।কিন্তু সব থেকে বেশি পেয়েছেন প্রায় তিন প্রজন্মের শ্রোতার ভালোবাসা।।এভাবেই নিজের সৃষ্টির জগতে মশগুল ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
    ১৯৩১ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করেন এই গীতিকার ও কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।তাঁকে প্রণাম।
Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.