Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে সতীর্থ স্বামী শিবানন্দকে একটি চিঠিতে গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে লিখছেন, ‘আমি তাঁর জন্মজন্মান্তরের দাসএই আমার পরম ভাগ্য। তাঁর একটা কথা বেদ-বেদান্ত অপেক্ষা অনেক বড়।’ গুরুভাইদের স্বামীজি অকপটে জানান, ‘এ জন্ম এ শরীর সেই “মূর্খ” বামুন কিনে নিয়েছেন। … তিনি যে তাঁর কার্যভার আমার স্কন্ধে নিক্ষেপ করে গেছেন। তা যে পর্যন্ত না সমাপ্ত করতে পারি, সে পর্যন্ত তিনি তো বিশ্রাম করতে দেবেন না।’
নরেন্দ্রনাথকে দেখিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন: ‘তুই আমি কি আলাদা? এটাও আমি, ওটাও আমি।’ বস্তুত রামকৃষ্ণ যন্ত্র, বিবেকানন্দ যন্ত্রী। রামকৃষ্ণ ভাষা, বিবেকানন্দ ভাষ্য। রামকৃষ্ণ ভাব, বিবেকানন্দ আন্দোলন। বিবেকানন্দের তীব্র-তীক্ষ্ণ অনুভব ‘আমি দেহহীন এক কণ্ঠস্বর’ (voice without a form)। এই কণ্ঠস্বরও শ্রীরামকৃষ্ণেরএকই সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বর শাশ্বত ভারতবর্ষের। সে ভারত দরিদ্র, অজ্ঞতায় পূর্ণ, কাতর কিন্তু প্রজ্ঞাসম্পদে ধনী, ঐতিহ্যে প্রাচীন, বহমানতায় সজীব, নবীন। এখানেই ভারত সুমহান। কোটি কোটি ভারতবাসীর ঐতিহ্যমণ্ডিত ভারতবর্ষের দু’হাজার বছরের সাধনার ঘনীভূত রূপ তিনিই (শ্রীরামকৃষ্ণ) রম্যাঁ রলা সমগ্র বিশ্বকে জানান সে কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা’র মিলিত রূপের concept রল্যাঁর ভাবনা থেকেই সঞ্জাত। ম্যাক্সমুলারের ‘প্রকৃত মহাত্মা,’ অল্ডাস হাক্সলি বা ক্রিস্টোফার ইশারউডের ফিনোমেন্যান ‘তিনিই’ রামকৃষ্ণ পরমহংস।

শ্রীরামকৃষ্ণ অনন্ত ভাবময়। সেই ভাবের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ নিরূপণ সম্ভবপর নয়। পাশ্চাত্য থেকে প্রথম বার ফেরার পর (১৮৯৭) রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা, মানবসেবা যজ্ঞে সন্ন্যাসীদের অংশগ্রহণ, স্কুল-হাসপাতাল স্থাপনা ও পরিচালনা, আর্ত-পীড়িতদের মধ্যে ত্রাণকাজ–এ সবের যৌক্তিকতায় সংশয় প্রকাশ করেছিলেন স্বামী যোগানন্দ। তাঁর মনে হয়েছিল, এগুলি ঠাকুরের (শ্রীরামকৃষ্ণের) কাজ নয়। তাঁর সেই সংশয় কাটাতে বিবেকানন্দের উত্তর ছিল – ‘তুই কী করে জানলি, এ সব ঠাকুরের ভাব (কাজ) নয়? অনন্ত ভাবময় ঠাকুরকে (শ্রীরামকৃষ্ণ) তোরা তোদের গণ্ডিতে বদ্ধ করে রাখতে চাস? ত্রিজগতের লোককে তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণের) ভাব দিতেই আমাদের জন্ম…তিনি পেছনে দাঁড়িয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। তিনি অনন্ত ভাবময়। ব্রহ্মজ্ঞানের ইয়ত্তা যদিও হয় তো, প্রভুর অগম্য ভাবের ইয়ত্তা নেই। তাঁর কৃপাকটাক্ষে লাখো বিবেকানন্দ এখনই তৈরি হতে পারে।’

এ বিনয় নয়। গুরুদেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশও নয়। বাস্তবকে স্বীকার। সেই স্বীকারোক্তি ধরা পড়ে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে, ‘তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণের) ভাবসমুদ্রের উচ্ছ্বাসের এক বিন্দু ধারণা করতে পারলে মানুষ তখনই দেবতা হয়ে যায়। সর্বভাবের এমন সমন্বয় জগতের ইতিহাসে আর কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়? এ থেকেই বোঝতিনি কী দেহ ধরে এসেছিলেন! অবতার বললে তাঁকে ছোট করা হয়।’
শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ‘প্রকৃত’ মানুষের জন্য। সেই মানুষ তাঁর আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হোক ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ নিয়ে। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়, মানুষ হয়ে উঠতে হয়। জন্মালেই এটা সম্ভবপর নয়। পাশব প্রবৃত্তির অপসারণে দেবত্বে উত্তীর্ণ হওয়াএ মানুষই পারে। তাই মানুষেই আস্থা শ্রীরামকৃষ্ণের। আত্মচৈতন্যে ভর দিয়েই অমৃতত্বের সন্ধানে তার এগিয়ে যাওয়াঅতঃপর অমৃতস্বরূপ হয়ে ওঠা। এই স্বরূপকে নিজের মধ্যে খুঁজতে হবে, বুঝতে হবে, প্রকাশ করতে হবে। আবার তেমনই, অন্য সকলের মধ্যেও সামাজিক অবস্থানে, সমদৃষ্টিতে অনড় থাকতে হবে। বেদান্ত দর্শনের মূল কথা এটাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম প্রচার করেননি, কোনও স্বতন্ত্র ধর্মগোষ্ঠী গড়েননি, বরং যা নিত্য, যা সত্যসর্বকালীন-সর্বজনীন একাধারে মনননিষ্ঠ এবং প্রাণে-প্রাণে অনুভবে সহজ-সরলসে দিকেই ছিল তাঁর অমেয় দৃষ্টিপাত। সকলকে এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ করা। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন খালি পেটে ধর্ম হয় না। আবার, ভরা পেটেও আত্মসুখী-আত্মপর হয়ে ওঠে মানুষ। এই আত্মপরতন্ত্রতার ঘোর বিরোধিতা করেছেন তিনি। বিবেকানন্দ যখন নিজের কথা ভেবে শুকদেবের মতো নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে থাকতে চেয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের ধিক্কার ঝরে পড়েছিলকারণ, বহু মানুষের জন্য নরেন্দ্রনাথ জীবন উৎসর্গ করবেসেটিই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের ঈপ্সিত। ঈশ্বর লাভ তো সম্ভব মানুষের মধ্যেই। মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের নামে যে সন্ন্যাসী সঙ্ঘ গড়ে উঠতে যাচ্ছিল, তার লক্ষ্য তিনি নিজেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তাই বিবেকানন্দ বলেছেন যে, গেরুয়া ভোগের নয়ত্যাগের প্রতীক। আত্মপরতার নয়পরহিতের। সন্ন্যাসী, শিষ্য অনুরাগীদের বলেছেন, ‘পরহিতায় পরসুখায়’ জীবন বিসর্জন দিতে। একটা গোটা জীবন।

ত্যাগে-প্রেমে-ভালবাসায় শ্রীরামকৃষ্ণ অতুলনীয়। গলরোগে আক্রান্ত হয়ে অশক্ত শরীরে দুঃসহ যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষের কল্যাণে নানা প্রসঙ্গ যখন তিনি আলোচনা করছেন, তখন দেহের কথা স্মরণ করিয়ে কেউ বাধা দিলেই বলে উঠেছেন ‘দেহের কষ্ট!…যদি একজন লোকের (এতে) যথাযথ উপকার হয়, সে জন্য আমি হাজার হাজার দেহ দিতে প্রস্তুত আছি। আমি বার বার জন্মাতে রাজি আছি, এমনকী কুকুর হয়ে জন্মাতেও রাজিযদি তাতে একজন লোকেরও উপকার হয়, সাহায্য হয়।’ এই কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনি বিবেকানন্দের কণ্ঠে, ‘আমায় যদি হাজারো জন্ম নিতে হয়, তাও নেবো। তাতে যদি কারো এতটুকু দুঃখ দূর হয়, তা করবো।’

সমাজে মানুষের মধ্যে যত বেশি ঈর্ষা, অহঙ্কার, অভিমান, সঙ্কীর্ণতা, যুদ্ধ-সংঘাত, হিংস্রতাততই বেশি সারশূন্যতা, পতন, পরাজয়, বিদূষণ। তাই, রামকৃষ্ণের নিদান অভেদভাব, জ্ঞানলাভসেই অনুভবে সহাবস্থানসহধর্মিতা-সহযোগিতা। সত্য কলির তপস্যা ও সিদ্ধি। সত্যকে ছাড়া চলবে না। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রবল ভাবেই সত্যাশ্রয়ী, সত্যানুরাগী, সত্যানুসন্ধানী। মন-মুখ এক করার মধ্যেই এই ‘সত্য’-র স্বতোচ্ছল উদযাপন।

ঊনিশ শতকে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান প্রভৃতির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে নবজাগরণের বার্তা বহন করে নিয়ে এলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-১৮৮৬)। প্রাক-আধুনিক যুগে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চর্চার ক্ষেত্রে পৌরাণিক ও লৌকিক প্রভাবই প্রাধান্য পেয়েছিল। উনিশ শতকে ধর্মের নামে কুপ্রথা, কুসংস্কারের ব্যাপক প্রচলন আমরা দেখেছি। কৌলীন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতি অমানবিক-অবিবেকী প্রথা ছিল এর অঙ্গীভূত। হিন্দু কলেজ (১৮১৭), ডিরোজ়িয়ো, ইয়ং বেঙ্গলকে কেন্দ্র করে ধর্ম ও সমাজসংস্কারের যে প্রবাহ লক্ষ করা গিয়েছিল, তাও যথাযথ পরিচালিত হয়নি। বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে বড় মাপের বিদ্বেষ-সংঘাত ছিল পরিচিত ছবি।

রামমোহন ও দ্বারকানাথ, পরে দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার প্রমুখ আত্মীয়সভা-তত্ত্ববোধিনী সভা-ব্রাহ্মসভা এবং ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষিত অভিজাতদের সমর্থন নিয়ে পরিস্থিতিকে সামাল দিতে চাইলেও, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করা গেল না। বঙ্কিমচন্দ্র-শশধর তর্কচূড়ামণি প্রমুখের নব্যহিন্দু আন্দোলনেও ধর্ম-সংস্কৃতি-আধ্যাত্মিকতার পূর্ণায়ত রূপ সমাজজীবনে প্রতিফলিত হল না। তামাম ভারতের সাধারণ মানুষের মানবিক মুখের ছবিও ফুটে উঠল না।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের আবির্ভাব ও অবস্থান এমনই সময়ে। সাধারণ মানুষকে যিনি চৈতন্যলোকের খোঁজ দিয়েছেন। নিজের মুক্তি নয়, জগতের মুক্তি— অন্য সকলের সুখ-সমৃদ্ধি প্রাধান্য পেল তাঁর চিন্তায়। গ্রামীণ ভারতবর্ষ থেকে আগত দেশের রাজধানী কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণেশ্বরের শক্তিমন্দিরকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ নানা শাখা-উপশাখায় সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন ধর্মের সারসত্য। ধর্ম যে অন্তরের বিষয় তা তিনি ঘোষণা করলেন। এই অন্তর উপলব্ধির নিরিখে মনোজগতের পরিবর্তনে তিনি গুরুত্ব আরোপ করলেন। বৈদিক ঋষির প্রজ্ঞায় অনুভব করলেন, জীবে-জীবে ব্রহ্মের অবস্থান। তাই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল শিবজ্ঞানে জীবসেবার কথা। আধ্যাত্মিক নবজাগরণের পথিকৃতের ভূমিকায় আমরা পেলাম তাঁকে।

তিনি এই শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ শুধু মেলে ধরেননি; নিজে হাতে সেই কাজ শুরু করেছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে। আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে এই জীবসেবার কাজ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আনুষ্ঠানিক ভাবে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার আগেই বহরমপুরের কাছে সারগাছির মহুলা গ্রামে মাত্র চার আনা সম্বল করে রামকৃষ্ণের পার্ষদ স্বামী অখণ্ডানন্দজি রামকৃষ্ণের স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু করেছিলেন যে সেবাকাজ তা উত্তরকালে ব্যাপকতর রূপ নিয়েছে।

উনিশ শতকের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তো বটেই, হিন্দু ধর্মের শাখাগুলির মধ্যে সংঘাত ছিল প্রবল। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবনে অনুশীলন করে দেখিয়েছেন, প্রতিটি ধর্মের উৎস যেখানেই হোক না কেন, তা একটি সত্যেই মিলিত হয়েছে। সেই সত্য উদার এবং মানবিক। যে সেকুলার ধর্মবোধের কথা আজ আমরা বলি, স্বাধীন ভারতের সংবিধানে যার গুরুত্ব অপরিসীম, তার প্রতিষ্ঠা শ্রীরামকৃষ্ণেরই হাতে। আধ্যাত্মিকতা একটি নতুন দিগন্ত স্পর্শ করল।

সঙ্ঘশক্তির উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মহাসমাধির আগে ত্যাগী পার্ষদদের হাতে গৈরিক বসন তুলে দিয়ে বলেছিলেন, মানবকল্যাণব্রতে একসঙ্গে শামিল হতে। সেই সূত্রেই ১৮৮৬-তে রামকৃষ্ণ মঠ এবং ১৮৯৭-এ (১ মে) রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা। এ ক্ষেত্রে গৃহী পার্ষদদের গুরুত্বও তিনি চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট করে দেন।

আধ্যাত্মিকতা মানে শুধু জপ-ধ্যান-তীর্থ পর্যটন নয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষ পারিপার্শ্বিক জগৎ ও জীবনের ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতা-স্বার্থপরতা-হিংসা-রিরংসা-লোভ-মোহ ইত্যাদি রিপুর প্রলোভনকে জয় করতে পারবে, শান্তি-প্রীতি-মৈত্রী চিদাকাশে আনন্দের উৎসার ঘটাতে পারবে। আমাদের অন্তরে যে ‘বিদ্বেষ বিষ’ তার কারণেই, নিরন্তর যে আনন্দধারা জগতে বহমান, তা অধরাই থেকে যায়। জীবনে আনন্দ অর্থাৎ ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুল হয়েছেন তিনি। অকৃত্রিম সারল্যে মানুষে-মানুষে, এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের বৈরিতা ঘুচিয়েছেন। যা বলেছেন, সব তাঁর অনুভূতিজাত। নিজের বিশ্বাস ও জ্ঞানকে জীবনচর্যায় প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন অবলীলায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, নিরাসক্তি আয়ত্ত করার কথা। বলেছেন শরণাগত হতে, আর বলেছেন সত্যকে প্রবল ভাবে আঁকড়ে ধরতে। সত্যের জন্য তিনি ভিতরে বাইরে লড়াই করেছেন। যে সত্যকে আজ আমরা লাঞ্ছিত করছি তাকে তিনি জীবনে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। ‘‘সত্যের জন্য সব কিছু ছাড়া যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ছাড়া যায় না।’’— বিবেকানন্দের এই উপলব্ধিও শ্রীরামকৃষ্ণ উদ্ভূত। এই সত্য হল তাঁর কথায় মন আর মুখকে এক করা। ‘মান’ নিয়ে আমাদের বিশেষ আগ্রহ, তেমন ‘হুঁশ’ও পাশাপাশি অবিচল রাখতে হবে। মানুষের মধ্যেই আছে ‘দেবত্ব’। সেই দেবত্বের খোঁজ যদি পায় মানুষ, তবে সে প্রকৃত অর্থেই ‘অমৃতের সন্তান’ হয়ে উঠবে। এত সহজ করে ধর্মের, আধ্যাত্মিকতার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেননি এর আগে। আধ্যাত্মিক নবজাগরণ তাঁর হাত ধরেই নতুন যুগধর্মের প্রতিবেশ রচনা করেছে, যা আজ দেশদেশান্তরে সমাদৃত।

শ্রীরামকৃষ্ণকে মানুষ ভগবান বা ঈশ্বর ভেবে যত না শ্রদ্ধা-ভক্তি করে তার থেকে বেশি শ্রদ্ধা করে তাঁকে অত্যন্ত আপনজন ও পরমাত্মীয় ভেবে। ঠাকুর বা দেবতারূপে তিনি যত কাছে আসেন, তার থেকে আরও বেশি কাছে আসেন আমাদের একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে। ছবির মাধ্যমে আজ তাঁর ঘরে ঘরে উপস্থিতি। সর্বত্রই তিনি এখন শ্রদ্ধার আসনটি অলঙ্কৃত করছেন। শুধু ছবিতে নয়, কথাতেও তিনি স্থান করে নিয়েছেন মানুষের মন-মন্দিরে। তাঁর জীবন-দর্শন পথহারা পথিকের পথপ্রদর্শক। গৃহী-ত্যাগী নির্বিশেষে সকলের দৈনন্দিন জীবনে তাঁর জীবনবাণী আজ অপরিহার্য। এর কারণ, তাঁর বাণীগুলি যুক্তিসিদ্ধ ও জীবন থেকে উঠে আসা তরতাজা। কখনও মনে হয় না তাঁর কথা অলীক ও অসম্ভব বলে। পরন্তু, সে কথা সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত রূপ নেয়।

‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ই এর জীবন্ত উপমা। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন-বাণী কথামৃত। যার ছত্রে ছত্রে রয়েছে জীবন থেকে উঠে আসা সারল্য ভাবের প্রামাণ্য নিদর্শন। সমস্ত শ্রেণির মানুষের পাঠোপযোগী। সহজ বাংলায় রচিত। সকল সমস্যার সহজ সমাধান সব জীবন-জিজ্ঞাসার উত্তর। এর চাহিদা কী রকম, তা বইমেলায় যথেষ্ট লক্ষণীয়। পাঠক মাত্রের মন ছুঁয়ে যায় ক্ষুধা মেটায়। ঐশ্বরিক ভাবের আবেশ আসে মনে। প্রাণে আসে দিব্য-ভাবের নির্মলানন্দ। অজান্তে ব্রহ্মানন্দে মন উদ্বেলিত হয়। এই মন-এর স্বরূপ কী, এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘মন যে রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজে ছোপাও সবুজ।’ মানুষ মনকে যে রঙে রাঙাবে সে রঙেই রঞ্জিত হবে। এ অনুভবী সিদ্ধান্ত তথা দর্শনকে অস্বীকার করতে পারি না, পরন্তু আকর্ষিত হই।

শ্রীরামকৃষ্ণের পূত-সান্নিধ্যে এলেই ঐশ্বরিক আকর্ষণ অনুভূত হয়। এমনই অনুভবের কথা লিখেছেন মুগ্ধ দর্শক মহেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামীজির মেজ ভাই এ ভাবে: “দক্ষিণেশ্বর থেকে এই যে লোকটি এসেছে, একেই কি বলে (রামকৃষ্ণ) পরমহংস? দেখিলাম, লোকটির চেহারাতে কোনও বৈশিষ্ট্য নাই, চেহারা সাধারণ পাড়াগেঁয়ে লোকের মতো।”… সে দিন কিশোর শ্রোতা মহেন্দ্রনাথ আরও দেখেছিলেন যে ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর অভ্যস্ত ভাবেই কথা বলে চলেছেন, ভাবগম্ভীর পরিবেশ এবং সে কথার ভাবের মধ্যে ছিল গভীরতা। তবে তিনি সেই সব সরল কথা যেটুকু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তা লিপিবদ্ধ করেছেন এ ভাবে: “এই মাত্র বিশেষ ভাবে বুঝিলাম যে, মনটাকে উপর হইতে নামাইয়া আনিয়া লোকটি কথা কহিতেছে, এবং আমাদের মনকে যেন আঠা দিয়া জুড়িয়া উপর দিকে লইয়া যাইতেছে। দেখিলাম যে, লোকটির প্রতি একটি টান আসিল। এ টান ভিতরের, লোকটির কাছে থাকিতেই ভাল লাগিতেছে। পরমহংস মশাই চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাঁর প্রতি ভিতর হইতে একটি টান রহিয়া গেল, সেটা যে অন্য প্রকারের জিনিস, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম।” এই ভগবত্‌প্রেমে আবদ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং স্বামীজিও। শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালবাসার মূর্ত প্রতীক বলে মনে করতেন। সে অনুভূতিকে তিনি ব্যক্ত করেছেন ৪টি অক্ষরে Love অর্থাৎ Love Personified মূর্তিমান প্রেম। তাঁর ভালবাসা পার্থিব সব ভালবাসাকে হার মানায়। মানুষকে যে মানুষ এত ভালবাসতে পারে তা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকেই শিখেছিলেন স্বামীজি। সে ভালবাসায় ছিল আত্মিক যোগসূত্র। তাই প্রেমময় শ্রীরামকৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয়টি দিয়েছেন স্বামীজি এ ভাবে : ‘রামকৃষ্ণ অবতার জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন। তাঁকে মানুষ বলো বা ঈশ্বর বলো বা অবতার বলো, আপনার আপনার ভাবে নাও। যে তাঁকে নমস্কার করবে সে সেই মুহূর্তে সোনা হয়ে যাবে।’ শ্রীরামকৃষ্ণ চুম্বকের উপমা দিতেন। বলতেন ‘চুম্বক যেমন লোহা টানে ভগবান তেমনই মানুষকে আকর্ষণ করেন।’ শ্রীরামকৃষ্ণও তেমনই আমাদের সবাইকে কাছে টানেন আকর্ষণী-শক্তিতে। তাঁর সান্নিধ্যে আসলে মানুষ অন্তরের টান অনুভব করেন। যে একবার এসেছে সে-ই ফেঁসেছে। কথামৃতকার শ্রীম ওরফে মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ঠাকুরকে দর্শন করতে এসেই আকর্ষিত হয়েছিলেন। একদিন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর ছোকরা ভক্তদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছেন এমন সময় মাস্টারমশাই (শ্রীম) এসেছেন তাঁকে দর্শন ও প্রণাম করতে। ঠাকুর তাঁকে দেখেই হাসিঠাট্টা থামিয়ে সকলের উদ্দেশে বলে উঠলেন“দ্যাখ, একটা ময়ূরকে বেলা চারটার সময় আফিম খাইয়ে দিয়েছিল। তার পর দিন ঠিক চারটার সময় ময়ূরটা উপস্থিত আফিমের মৌতাত ধরেছিল ঠিক সময় আফিম খেতে এসেছে।” শ্রীরামকৃষ্ণ রসিকচূড়ামণি। তাঁর রঙ্গ-রসিকতা শুনে উপস্থিত ছোকরারা একেবারে হেসে কুটি কুটি। তা দেখে সম্ভ্রান্ত উচ্চশিক্ষিত মাস্টার মনে মনে ভাবছেন ‘ইনি ঠিক কথাই তো বলেছেন। বাড়ি যাই কিন্তু রাতদিন এঁর কাছেই মন পড়ে থাকে কখন দেখব, কখন দেখব। আশ্চর্য কে যেন টেনে আনল! ইচ্ছা করলেও তো অন্য জায়গায় যাবার জো নেই। এখানে আসতেই হবে।”…

রামকৃষ্ণ রাম আর কৃষ্ণ। রাম অর্থে আনন্দ, কৃষ্ণ অর্থে আকর্ষণ। তিনি আনন্দময়, সর্বদা কাছে ডাকেন প্রেম বিলাতে। একসময় দক্ষিণেশ্বরের কুঠিবাড়ির ছাদে উঠে হাঁক দিয়েছিলেন “ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস, আয়। তোদের না দেখে প্রাণে বাঁচিনে।” এ তো শুধু ডাক নয়, এ যে আকুল আহ্বান। অন্তরের আকুতি। একান্ত আপনজনের মতো কাতর অপেক্ষা! তাই সে ডাকে সে দিন সাড়া দিতে নরেন রাখাল শরত্‌ কালী শশী প্রমুখ ত্যাগব্রতী যেমন ছুটে এসেছিলেন, তেমনই তাঁর কাছে টান অনুভব করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, কেশবচন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। এই সব বিদ্বজ্জন তাঁর আকর্ষণী সান্নিধ্যে এসে ভাব বিনিময়ে ধন্য হয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “প্রদীপ জ্বাললে বাদুলে পোকাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আপনি আসে ডাকতে হয় না। তেমনই যে আদেশ পেয়েছে, তার লোক ডাকতে হয় না, অমুক সময় লেকচার হবে বলে, খবর পাঠাতে হয় না। তার নিজের এমনই টান যে লোক তাঁর কাছে আপনি আসে।” সে টানে ছিল আত্মিক আকর্ষণ। তাঁর উপমার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনিই। তাঁর কথায় তিনিই ধরা পড়েন “অচিনে গাছ শুনেছ? তাকে কেউ দেখে চিনতে পারে না।” ঠাকুরের এ কথা শুনে মাস্টার বললেন, “আপনাকেও চিনবার জো নাই। আপনাকে যে যত বুঝবে সে তত উন্নত হবে।” শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের আপনজনবোধে আকর্ষণ করে কাছে ডেকে নিতে চান মান-হুঁশ করার জন্য। মানুষ তার মান সম্বন্ধে হুঁশ অর্থাত্‌ সচেতন হোক। জানুক সে অমৃতের সন্তান। অমৃতত্ত্ব লাভই হোক জীবনের উদ্দেশ্য। এই মরণশীল জীবনের চরম লক্ষ্য ও পরম বস্তুটি হল অমৃতত্ত্ব। যা তাঁর জীবন ও বাণীর মধ্যে স্তরে স্তরে সমৃদ্ধ এবং তা বিতরণের জন্য তিনি আহ্বান জানান।

পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য চরিত্র তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ইতিহাসচেতনার সমগ্রতা নিয়েই বলেছেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারবরিষ্ঠ।’ ধর্মে ধর্মে এত বিদ্বেষ দেখে এ যুগের মানুষ ধর্মকেই বিদায় দিতে চেয়েছে; দিয়েছেও। ধর্ম তো মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে শান্তি স্থাপন করবে! কিন্তু কী দেখতে পাই এবং এখনও। পৃথিবীটা যেন ঈশ্বরকে নিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত। ভারতভূমির এই অবস্থা। পৃথিবীর মানচিত্রটাও ততোধিক কলুষিত। অবস্থা এমনই যে এখন এক সম্প্রদায়ের অনুগামীদের অসংখ্য শত্রু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। সবাই ভগবানের কাছে যাবেন, বেশ। অন্যদের শত্রু ভেবে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নতি বিধানের দায় তাঁরা কোথায় পেলেন? তাঁদের অবতার তো সর্বজীবে প্রেম বিতরণই করেছেন। তবে?

এই প্রেক্ষিতে শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা আমাদের পরম পাথেয়। এই শিক্ষা এক কথায় অনন্য। তিনি জানালেন, জানাতে বললেন নরেন্দ্রনাথকে: এ পর্যন্ত ধর্মজগতে যত মত প্রচারিত হয়েছে (ভবিষ্যতেও যা হবে), সবগুলিই সত্য। তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যই প্রচারিত হয়েছে। সেই সত্যই মঠ-মিশনের মধ্যে আচরিত হয়। মঠের সন্ন্যাসীদের ভিতর যেমন জন্মসূত্রে সর্বধর্মের মানুষ আছেন, তেমনি ভক্তদের ভিতরও এঁরা সবাই আছেন। তিনি নারীকে নরকের দ্বার বলেননি, বলেছেন মা আনন্দময়ী, মা ভবতারিণীর সাক্ষাৎ মূর্তি। তাঁকে সন্ধান করো, পূজা করো, তিনি পথ না ছাড়লে জীব পথ পাবে না, তাঁরই নির্দেশ মেনে মা সারদা দেবীকে কেন্দ্রে রেখে স্ত্রী মঠের আবির্ভাব। এ এক নূতন বার্তা। নারীদের উপর হাজার হাজার বছরের অবিচার শেষ হল।

শাস্ত্র না পড়লে যে দিব্যদৃষ্টি খুলবে না, তা নয়। নিরক্ষর হলেও মা-ই সব দেখিয়ে দেন। তিনি ‘অশেষ ধর্মসমন্বয়তনু’ এবং ‘অনন্ত ভাবসাগরময়’। কামিনীকে ত্যাগ না করে তাঁকে মাতৃভাবে শুদ্ধ করে সহায় করে নিয়েছেন নিজে। ভক্তদেরও তাই নির্দেশ: দু’একটি ছেলেমেয়ে হলে স্বামী-স্ত্রী ভাইবোনের মতো থাকবে, কাঞ্চনকে সেবায় লাগাবে, শিবসেবায় কাঞ্চনের সদ্ব্যবহার হবে। এ সব পজিটিভ শিক্ষা। যোগের সমন্বয় সাধন এক আশ্চর্য ব্যাপার। কর্ম তো সেবাই এবং সেটিই বড় সহায়। কর্মকে শুদ্ধ করতে হবে, কর্মকে ভালবেসে। সুতরাং কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান সহযোগে মনকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করাই যোগ। এই ‘যোগ’ একটিই। সব পথগুলিই সম্মানের। ফল লাভ হয় যে! তাঁর সত্যনিষ্ঠাও বিস্ময়ের ব্যাপার।

তিনি এলেন; আবার সর্ব ধর্মমত উজ্জীবিত হয়ে উঠল। খ্রিস্ট সত্য হলেন, মহম্মদ সত্য হলেন, বুদ্ধ সত্য হলেন, রাম, কৃষ্ণ, সীতা সব সত্য হলেন তাঁর জীবনে। এবং পরোক্ষত আমাদের জীবনেও। আমরা জয় দিই তাঁরই নামে; তাঁরই নামে সবাই সুরক্ষিত, সবাই নিশ্চিন্ত। জয়ধ্বনির ঘোষণা এমনই হবে: জয় হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ সব ধর্মের জয়; জয় বেদ-বাইবেল, কোরান-পুরাণের জয়, জয় জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, যোগের জয়; জয় বুদ্ধ, রাম, কৃষ্ণ, খ্রিস্ট, মহম্মদ, চৈতন্য— সব অবতারদের জয়। জয় সর্বধর্মের, সর্বভাবের, সর্ব অবতারের ঘনীভূত প্রতিমা শ্রীরামকৃষ্ণের জয়। সবার ধর্মই তাঁর ধর্ম। তাঁর নিজের কোনও ধর্ম নেই। তাই তিনি উদার, শ্রেষ্ঠ এবং গভীরতম। তাঁকে ধরেই পৃথিবী বাঁচবে। তাঁর বার্তা যে গ্রহণের, বাতিলের নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ-মিশনে কারও তিরোধান দিবস নিয়ে তেমন ব্যস্ততা থাকে না। বিশ্বসংসারের মৃত্যুহীন প্রাণেরা তো দেহাবসানের পরেই নতুন ভাবে বেঁচে ওঠেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও একই আইন, তবু কাশীপুর উদ্যানবাটীতে বহু যুগ আগে শ্রাবণের শেষ কয়েকটি দিনে ভক্তজনদের বিনিদ্র রজনীর বৃত্তান্ত জানবার জন্য নতুন যুগের মানুষদের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। ইদানীং সংবাদপত্রের ছোট্ট একটি খবরে সেই আগ্রহ আরও বেড়েছে। কলকাতা কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ তাঁদের শ্মশানঘাটের একটি ঐতিহাসিক রেজিস্টার থেকে রামকৃষ্ণ-দেহাবসানের নথিপত্রের ছবি বেলুড়ের সংগ্রহশালায় দান করা হয়েছে।

১৯০২ সালে দেহাবসান হলেও স্বামী বিবেকানন্দের কোনও ডেথ সার্টিফিকেট নেই। এ বার অন্তত ঠাকুরের ইতিহাসটা আরও একটু জোরদার হল। যে দিনটি এত বছর পরে আবার মানুষের কৌতূহলে পূর্ণ হয়ে উঠতে চাইছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্তলোক-যাত্রার সেই তারিখটি কবে? ১৫ই আগস্ট? না পরের দিন? পরবর্তী সময়ে দুটি কারণে ১৫ই আগস্ট মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাতচল্লিশের মধ্যরাতে ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ এবং তারও বেশ কিছু দিন আগে আজকের থিয়েটার রোড বা শেক্সপিয়র সরণিতে শ্রীঅরবিন্দের আবির্ভাব দিবস (১৫ই আগস্ট ১৮৭২)।

শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানও ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে, এ কথা অনেকেই জানেন। যার থেকে ‘শ্রাবণের শেষ দিনে কাশীপুরে’ এই কথাটা ভক্তদের মুখে মুখে ঘুরত। কিন্তু শ্মশানের খাতা তো ভুল করে না। সেখানে ৯৫০ নম্বর এন্ট্রিতে লেখা ছিল — ১৫ই আগস্ট ১৮৮৬! এখন সবাই বোঝে, মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরোলেই তারিখ পাল্টে যায়। যদিও বাংলা হিসেবে সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত পুরনো তারিখটাই থেকে যায়। তাই জন্ম-মৃত্যুর হিসেবে প্রায়ই একটা দিনের পার্থক্য এসে যায়। এই গোলমাল কাশীপুরে সরকারি ভাবে সংরক্ষিত প্রয়াণ-নথিতে রয়ে গিয়েছে। সাবধানী লেখক স্বামী প্রভানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে (প্রথম প্রকাশ আষাঢ় ১৩৯৪) সরকারি নথি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন:

“রাম কিষ্টো প্রমোহংশ
৪৯ কাশিপুর রোড্, বয়স ৫২
মৃত্যু তারিখ- ১৫ আগস্ট ১৮৮৬
সেক্স-পুরুষ, গতি ব্রাহ্মণ
পেশা- ‘প্রিচার’
মৃত্যুর কারণ-গলায় আলসার
কে রিপোর্ট করেছেন-
জি সি ঘোষ, বন্ধু”

সাম্প্রতিক সংবাদপত্রে সংক্ষেপিত ‘জি সি ঘোষ’ নামটি থাকায় বিভ্রান্তি কিছু বেড়েছে। অনেকে ধরে নিয়েছেন সংবাদদাতা ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ’—যাঁকে সঙ্ঘের অনেকেই ‘জি সি’ বলে ডাকতেন।

এক সময় এই জি সি ঘোষের খোঁজখবর নিয়েছিলেন বিখ্যাত লেখক ও গবেষক শংকর। তিনি জানতে পারেন যে, জি সি ঘোষ নামাঙ্কিত ব্যক্তির পূর্বনাম গোপালচন্দ্র ঘোষ (সুর), জন্ম ১৮২৮, যৌবনকালে চিনাবাজারে বিখ্যাত বেণীমাধব পালের দোকানে সামান্য চাকরি করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ১৮৭৫, বয়সে বড় বলে ঠাকুর এই ভক্তকে ‘বুড়োগোপাল’ বলে ডাকতেন। ইনিই নরেন্দ্রনাথ প্রমুখকে ১২খানি গেরুয়া ও রুদ্রাক্ষের মালা বিতরণ করেন— এর মধ্যে শেষ উপহারটি রাখা হয়েছিল গিরিশ ঘোষের জন্য। গোপাল পরবর্তী কালে বরাহনগরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, নাম হয় স্বামী অদ্বৈতানন্দ। মঠ মিশন ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম মিটিংয়ে তিনিই সভাপতিত্ব করেন (১৯০১) এবং পরবর্তী কালে দু’বার মঠের অস্থায়ী সভাপতি হন। বেলুড় মঠে তাঁর দেহাবসান ২৮শে ডিসেম্বর ১৯০৯ সালে।

ঠাকুরের শেষ দিনগুলির কাশীপুর-বৃত্তান্ত দুই ভুবনবিদিত জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও স্বামী সারদানন্দ কেউই বিস্তারিত ভাবে লিখে যাননি। মহেন্দ্রনাথ শুধু লিখেছেন, ঠাকুর দশ মাস ধরে ভুগেছিলেন, গলায় ঘা হয়েছিল, ভক্তেরা সেবা করে পরিশ্রান্ত, ‘‘ডাক্তারের হাত ধরে কাঁদতেন, ভাল করে দাও বলে’’ এবং শেষকালে বলতেন, ‘‘মা আমার শরীর রাখবেন না।’’ কথামৃত-য় শেষ বিবরণ ২৪শে এপ্রিল ১৮৮৬। লীলাপ্রসঙ্গ-রচয়িতা স্বামী সারদানন্দও কাশীপুরের শেষ অসুখের দিনগুলির বিবরণ লেখেননি। এ বিষয়ে স্বামী চেতনানন্দ খোঁজখবর করেও বিশেষ কোনও বিবরণ দেখেননি।

শ্রীম ও স্বামী সারদানন্দ যে ঠাকুরের দেহাবসানের পরে কাশীপুরে উপস্থিত ছিলেন, তার প্রমাণ বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স-এর ১৬ই অগস্ট ১৮৮৬ তারিখের তোলা ছবিতে রয়েছে।

কথামৃত ও লীলাপ্রসঙ্গে অন্ত্যলীলা পর্বের খবর তেমন না থাকলেও প্রয়োজনীয় বিবরণের অভাব হয়নি। ছড়ানো-ছিটানো এই সব স্মৃতিকথা থেকে স্বামী প্রভানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ বইতে অনেক খবর পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। অন্য একটি বইয়ে বর্ণিত হয়েছে কথামৃত রচয়িতা শ্রীম-র জীবনের পরবর্তী কালের একটি ঘটনা। বহু বছর পরে (৩০শে মার্চ ১৯২৪) তিনি একবার কাশীপুর উদ্যানবাটী দর্শনে গিয়েছিলেন। তখন এক আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান ওই বাড়িতে বাস করতেন। ঘরের একটি অংশ দেখিয়ে শ্রীম বললেন, ‘‘এইখানে ঠাকুরের বিছানা ছিল। … দক্ষিণ দেয়ালের দিকে ছিল ঠাকুরের শিয়র।’’
সে দিন ডা. বকশি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ঠাকুর কেন খাটে শুতেন না?’’ শ্রীম—‘‘মেঝেতে শোয়া সুবিধে ছিল। দুর্বল শরীর, মাদুরের ওপর শতরঞ্চি। তার ওপর বিছানা।’’

শংকর নিজেও এক সময় এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘শ্রাবণের শেষ দিনে কাশীপুর উদ্যানে’। সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, দক্ষিণেশ্বরে অনেক দিন শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। সুস্থ অবস্থায় তিনি আধসের থেকে দশ ছটাক চালের ভাত খেতেন। ব্যাধি বলতে আমাশয়। আর ছিল বায়ুবৃদ্ধি রোগ। কবিরাজদের পরামর্শ মতো ছিলিমের ভেতর ধানের চাল ও মৌরি দিয়ে তামাক খেতেন। তাঁর গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ অগস্ট ১৮৮৫। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’। প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁকে দেখেন ২রা সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ এবং পরের মাসে (১২ই অক্টোবর) নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁরই সিদ্ধান্ত, রোগটা ক্যানসার, কবিরাজি ভাষায় রোহিণী রোগ। বাড়িওয়ালার চাপে শ্যামপুকুর আশ্রম ছেড়ে ৯০ কাশীপুর রোডে মাসিক ৮০ টাকায়, ছ’মাসের জন্য চুক্তি। এখান থেকেই নরেন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের কাছে বিডন স্ট্রিটে পীরুর রেস্তোরাঁয় ফাউল কারির অর্ডার দিয়েছিলেন। সে রিপোর্ট ঠাকুরের কাছেও গিয়েছিল।
খরচাপাতির টানাটানি ও সেবকের সংখ্যা কমানোর বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনে বিরক্ত ঠাকুর প্রিয়জনদের বলেছিলেন, ‘‘তোরা আমাকে অন্যত্র নিয়ে চল … তোরা আমার জন্য ভিক্ষা করতে পারবি? তোরা আমাকে যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানেই যাব।’’
২৫শে মার্চ ১৮৮৬ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জে এম কোটস এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। শোনা যায়, ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায় ডাক্তার কোটসকে বত্রিশ টাকা দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ডা. কোটস ভিজিট নেননি।
বিখ্যাত ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এলেন ৬ই এপ্রিল ১৮৮৬। এঁকে ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় তাঁর পিলের চিকিৎসা হয়েছিল। কাশীপুরে মাঝে মাঝে রাঁধুনির অনুপস্থিতিতে রাঁধতেন ভক্ত তারক (পরবর্তী কালের স্বামী শিবানন্দ)। এক দিন খাবারের গন্ধ পেয়ে ঠাকুর বললেন, ‘‘আমার জন্য একটু চচ্চড়ি নিয়ে আয়।’’
‘শ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত’ বইতে ভক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, ‘‘আগস্ট মাসে ঠাকুর বললেন, ইচ্ছে হয় ইজের পরে ডিশবাটিতে খাই। সেই মতো ব্যবস্থা হওয়ায় প্রভু খুব আনন্দ করলেন।’’
এই সময়েই আসন্ন দেহত্যাগের আশঙ্কা বুঝতে পেরে ঠাকুর তাঁর সহধর্মিণীকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে। শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে। … কারও কাছে একটি পয়সার জন্য চিতহাত কোরো না, তোমার মোটা ভাতকাপড়ের অভাব হবে না।’’
রবিবার ১৫ই অগস্ট ১৮৮৬, কাশীপুরে শ্রাবণের শেষ দিনে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ‘বেশ ভাল’। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, ‘‘আজ ভাতের পায়স খাব’’ শুনে সকলে আশ্বস্ত। কিন্তু ওই দিনেই ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘‘ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি খাই, কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।’’

শেষের সেই দিনে খিচুড়ি নিয়েও বিশেষ গোলযোগ। সেবকদের জন্য শ্রীমা যে খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নীচের অংশ ধরে গেল।
বিকেলের দিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় ভক্ত শশী (পরবর্তী কালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়ে ডা. নবীন পালকে ধরে নিয়ে এলেন। ঠাকুর বললেন, ‘‘আজ আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে।’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘সারবে?’’ ডাক্তার নিরুত্তর।
এক সময় ঠাকুর ভক্তদের বললেন, ‘‘একেই নাভিশ্বাস বলে।’’ ভক্তরা বিশ্বাস করল না। তাঁরা ভাতের মণ্ড নিয়ে এল।
তখন প্রায় রাত ন’টা। হঠাৎ ঠাকুরের সমাধি। নরেন সবাইকে ‘হরি ওঁ তৎসৎ’ কীর্তন করতে বললেন। সমাধি ভঙ্গ হল রাত প্রায় এগারোটায়। সেবক শশীর ইংরেজিতে রাখা নোট অনুযায়ী, ‘পুরো এক গ্লাস পায়েস পান করেন।’ তার পর ঠাকুর নাকি বলেন, ‘আঃ শান্তি হল। এখন আর কোনও রোগ নেই।’
স্বামী অভেদানন্দ এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ঠাকুরের শেষ মুহূর্তের বিস্তারিত বিবরণ রেখে গিয়েছেন— ‘‘একটা বাজিলে অকস্মাৎ তিনি একপাশে গড়াইয়া পড়েন। তাঁহার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হইতে থাকে। নরেন তাড়াতাড়ি তাঁহার পা লেপে ঢাকিয়া ছুটিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া যান। এ দৃশ্য তিনি সহিতে পারিতেছিলেন না। নাড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমরা সকলে ভাবিলাম, উহা সমাধি।’’
সেই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ভাইপো রামলালকে খবর দেওয়া হল। রামলাল এসে বলল, ‘ব্রহ্মতালু গরম আছে, তোমরা একবার কাপ্তেন উপাধ্যায়কে খবর দাও।’ তিনি তাড়াতা়ড়ি এসে বললেন, মেরুদণ্ডে গব্যঘৃত মালিশ করলে চৈতন্যোদয় হবে। তিন ঘণ্টার বেশি মালিশ করেও কোনও ফল হল না।
১৬ই অগস্ট সকালবেলায় ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের কাশীপুরে আবির্ভাব। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের রচনা অনুযায়ী, পরদিন প্রত্যুষে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সর্বপ্রথম উদ্যানে উপস্থিত হন। অভেদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী, ডা. সরকার ‘‘বেলা দশ ঘটিকায় এসে নাড়ি দেখে বলেন, ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে।’’ অনেক বিচার-বিবেচনার পর স্বামী প্রভানন্দের মতামত, ‘ডাক্তার সরকার কাশীপুর পৌঁছান বেলা একটায়।’
ডাক্তার সরকারের দিনলিপি, ‘‘খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তাঁর দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eyes open, mouth partly open,…।’’
এর পরে লেখা, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল ছবি তোলার পরামর্শ দিলেন এবং নিজের চাঁদা হিসেবে দশ টাকা রেখে গেলেন।
বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের ছবি তোলা সম্বন্ধে অভেদানন্দের বর্ণনা: ‘রামবাবু নিজে খাটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে বলিলেন। আমরা সকলে নির্বাক হইয়া সিঁড়ির ওপরে দাঁড়াইলাম। বেঙ্গল ফটোগ্রাফার কোম্পানি দুইখানা গ্রুপ ফটো তুলিয়া লইলেন।’ কাশীপুর মহাশ্মশানের উদ্দেশে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিকেল ছ’টার পর।

১৬ই অগস্ট ১৮৮৬ তারিখে তোলা বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের দুটি গ্রুপ ফটোগ্রাফের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। মঠ মিশনের কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক কারণেই এই ছবির প্রচারে কোনও দিন উৎসাহিত হননি। বৈকুণ্ঠনাথের মন্তব্য: ‘পরিতাপের বিষয়, অত্যধিক লম্বাবশত প্রাতঃকালের সে জ্যোতির্ময় ভাবটি তখন অস্তমিত হইয়াছিল।’

সহজলভ্য না হওয়ায় এক সময় গ্রুপ ছবিটি সাইক্লোস্টাইল অবস্থায় বিক্রি হত। এক সময়ে চিরনিদ্রায় শায়িত রামকৃষ্ণের দেহ বাদ দিয়ে এই ছবি প্রচারিত হত। পরবর্তী সময়ে মার্কিন গবেষকরা এই ছবিটি নিয়ে নানা ভাবে গবেষণা করেছেন এবং সেইমতো বিস্তারিত ক্যাপশন লিখেছেন।
ঐতিহাসিক এই ছবিটির সব নায়ককে আজও শনাক্ত করা যায়নি। কারা সে দিন উপস্থিত ছিলেন আর কারা ছবিতে স্থান পাননি, তা বোঝা এত দিন পরে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় তৈরি বিবেকানন্দ অ্যালবামে তেত্রিশ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তা ছাড়াও আরও উনিশ জনকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। খুঁটিয়ে দেখলে কয়েকটি বালকের মুখও নজরে আসে। মার্কিন সম্পাদকরা ছবির বাঁ দিকে কিছু তোশক-বালিশের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁদের ধারণা, এগুলি ঠাকুরের ব্যবহৃত। যাঁদের শনাক্ত করা গিয়েছে, তাঁরা হলেন: (১) অতুলচন্দ্র ঘোষ, (২) অমৃত, (৩) বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল, (৪) ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়, (৫) বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ), (৬) নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দ), (৭) রামচন্দ্র দত্ত, (৮) গোপালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী অদ্বৈতানন্দ), (৯) শরৎ (স্বামী সারদানন্দ), (১০) বলরাম বসু, (১১) লাটু (স্বামী অদ্ভুতানন্দ), (১২) শশী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), (১৩) রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), (১৪) নিত্যগোপাল বসু, (১৫) যোগীন্দ্র (স্বামী যোগানন্দ), (১৬) দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, (১৭) তারক (স্বামী শিবানন্দ), (১৮) হুটকো গোপাল, (১৯) নিত্যনিরঞ্জন (স্বামী নিরঞ্জনানন্দ), (২০) নারায়ণ, (২১) মণিলাল মল্লিক, (২২) ফকির, (২৩) সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, (২৪) ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায়, (২৫) হরিশচন্দ্র মুস্তাফি, (২৬) গিরীন্দ্রনাথ মিত্র, (২৭) বিনোদবিহারী ঘোষ, (২৮) শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত), (২৯) কালী (স্বামী অভেদানন্দ), (৩০) নবগোপাল ঘোষ, (৩১) গঙ্গাধর (স্বামী অখণ্ডানন্দ), (৩২) মহিমাচরণ চক্রবর্তী, (৩৩) মনমোহন মিত্র।

বলা বাহুল্য, এই ছবিটি নিয়ে আরও খোঁজখবর করার প্রয়োজন এখনও রয়েছে। দুটি ছবিতে কিছু পার্থক্যও রয়েছে, সবাই এক জায়গায় নেই। বিবেকানন্দ-ভক্তরা লক্ষ করেছেন, একটি ছবিতে তিনি খালি গায়ে, আর একটিতে গায়ে ওড়না অথবা ধুতির খুঁট দেখা যাচ্ছে।
আরও নানা খবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ নাকি ঠাকুরের মহাসমাধির পরে একবার গঙ্গায় ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন—শোক সামলাতে পারছিলেন না। আরও অনেক কিছু ঘটেছিল সে দিন উদ্যানবাটীতে এবং মহাশ্মশানে। পরবর্তী কালে আরও স্পষ্ট, শিষ্যেরা দাহের পক্ষে ছিলেন না, তাঁরা চেয়েছিলেন সমাধি। বিবেকানন্দের এক চিঠি— ‘‘ভগবান রামকৃষ্ণের শরীরে নানা কারণে অগ্নি সমর্পণ করা হইয়াছিল। এই কার্য যে অতি গর্হিত তার আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে তাঁহার ভস্মাবশেষ অস্থি সঞ্চিত আছে। উহা গঙ্গাতীরে কোনও স্থানে সমাহিত করিয়া দিতে পারিলে উক্ত মহাপাপ হইতে কথঞ্চিৎ বোধ হয় মুক্ত হইব।’’
স্বামী অভেদানন্দ লিখছেন—‘‘নরেন্দ্রনাথ বলিল, ‘দ্যাখো, আমাদের শরীরই শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন্ত সমাধিস্থল। এসো, আমরা সকলে তাঁহার পবিত্র দেহের ভস্ম একটু করে খাই আর পবিত্র হই।’ নরেন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম কলসি হইতে সামান্য অস্থির গুঁড়া ও ভস্মগ্রহণ করিয়া ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলিয়া ভক্ষণ করিল।’’

১৬ই অগস্টের বিকেলবেলার অনেক বিবরণ পরবর্তী কালে ধৈর্য সহকারে সংগৃহীত হয়েছে। সে দিন আকাশে ‘‘বর্ষা মেঘের হাল্কা আবরণ। … মহাসমাধিস্থ মহাপুরুষের শরীর বাহিরে আনয়নপূর্বক এক বিস্তীর্ণ শয্যায় শয়ন করাইয়া আর্দ্র বস্ত্রে অঙ্গ পরিষ্কার করিয়া দেওয়া হইল। অদ্য মনের সাধে জন্মের মত চন্দন পরা হইল। … প্রভু আমার যেন ফুলশয্যায় শয়ন করিয়াছেন।’’ আর এক জন রামকৃষ্ণ-অনুরাগী, ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিবরণ: ‘‘তাঁর মাথার নিচে একখানি আর পা-দুখানির মধ্যে আর একটা বালিশ … একখণ্ড মেঘ থেকে বড় বড় দানার বৃষ্টি ঝরে পড়ল। উপস্থিত সকলে বলতে থাকল এই হচ্ছে পুরাণকথিত স্বর্গ থেকে ঝরে পড়া পুষ্পবৃষ্টি। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, কলিকাতা হইতে একশত, দেড়শত লোক যাইয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন।’’
স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন, ‘‘এক ঘণ্টার মধ্যে চিতা স্বকার্য সাধন করিয়া লইল, যখন চিতানল পূর্ণপ্রভাবে জ্বলিতেছিল, সেই সময় ঠিক চিতার উপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হইয়াছিল।’’
ঠিক কখন মহাসমাধি লাভ হয়েছিল, তা নিয়ে সামান্য মতভেদের উল্লেখ করেছেন স্বামী প্রভানন্দ। ১৬ই অগস্ট প্রাতঃ ১টা ২ মিনিট। অন্য মতে ১টা ৬ মিনিট। সরকারের কাছে রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয়নি, বুড়োগোপাল এই রিপোর্ট দাখিল করেন তিন দিন পরে।

শ্মশানে আরও অনেক কিছু ঘটেছিল। বিশেষ ভক্ত ‘বসুমতী’ পত্রিকার সতীশ মুখোপাধ্যায়কে শ্মশানে সাপে কামড়েছিল। আরও শোনা যায়, কেউ কেউ শ্মশান থেকে অস্থি সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বুটে। সেগুলো নাকি এক সময় পুজো করা হত। নরেন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই হাবু দত্ত (অমৃতলাল) পরবর্তী কালে গলায় একটি হাড়ের মালা পরতেন, যা নাকি শ্রীরামকৃষ্ণের পূতাস্থিতে তৈরি। আরও নানা কাহিনি এত দিন পরেও লোকমুখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কোনও ধৈর্যশীল গবেষক সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করে এ কালের পাঠকদের উপহার দিলে মন্দ হয় না। সেই সঙ্গে আশঙ্কা হয়, ঠাকুরের কিছু অস্থি কোথাও কোথাও আজও লুকিয়ে আছে।

শেষ করি তাঁর আগমনের তাৎপর্য উল্লেখ করে। সবধর্মকে মান্যতা দিয়ে তিনি প্রত্যেকটি ধর্মকে সত্য বললেন। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মকেই প্রত্যেককে নিষ্ঠার সঙ্গে ধরতে হবে, অন্য সব ধর্মকে অন্যদের জন্য সত্য বলে শ্রদ্ধা করতে হবে। অন্যদের ধর্মান্তরিত করে নিজের ধর্মের আওতায় আনাই সব বিদ্বেষের মূল। সুতরাং শ্রীরামকৃষ্ণ হিন্দুকে ‘বেটার হিন্দু’, খ্রিস্টানকে ‘বেটার খ্রিস্টান’, মুসলমানকে ‘বেটার মুসলমান’, বৈষ্ণবকে ‘বেটার বৈষ্ণব’— হতে বলছেন। কেমন করে? নিজের মতে একশো শতাংশ নিষ্ঠা রেখে। অন্যের মতগুলিকে শ্রদ্ধা জানানোই যথার্থ ধর্মপ্রচার। ধর্মপ্রচার মানে নিজস্ব ধর্মমতের অনুগামীদের সংখ্যা বাড়ানো নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর তখন স্থূলে নেই। পুরীধামে স্বামী প্রেমানন্দ কোনও এক সন্ধ্যায় এক খ্রিস্টান পাদরির ধর্মসভা ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন লোকজন নিয়ে গিয়ে মহাসংকীর্তন শুরু করে। সেই রাতে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখা দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন— এ তুই কী করলি? ও তো আমারই কথা প্রচার করছিল। খ্রিস্ট আর আমি কি আলাদা? কাল তুই তার কাছে ক্ষমা চাইবি, আর তার ধর্মসভার বন্দোবস্ত করে দিয়ে অন্যায়ের প্রতিকার করবি।

শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তেরও এই দায়। তাঁদের হাতেই সর্বধর্ম সুরক্ষিত থাকবে। এত বড় দায় তাঁদের মাথায় যে রয়েছে, তা তাঁরা যেন বোঝেন।

(তথ্যসূত্র:
১- রামকৃষ্ণ-সারদা: জীবন ও প্রসঙ্গ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত (অখণ্ড), শ্রীম কথিত, মাইতি (২০১৭)।
৩- পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ (চারখণ্ড), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১৪)।
৪- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ রহস্যামৃত, শংকর, দে’জ পাবলিশিং

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.