পরমার্থ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসতেই করবী চায়ের কাপ-প্লেট হাতে তার সামনে ,যতটাসম্ভব সে শাড়ি দিয়ে ঢেকেছে তার শরীর।
কারণ প্রায় দিন -ই তার শরীরে অত্যাচারের চিন্হ,একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বিষন্ন মনে দেখতে ভালোলাগবেনা পরমার্থর– এটা করবীর অনুভূতি ছুঁয়ে যেত।স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা করবীর ছিল,আসলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত তার ওপর এত বড় একটা কোম্পানীর প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব সগর্বে বহাল রেখেছে,তার মধ্যেও স্ত্রীকে যথেষ্ট সময় দেওয়া, চোখের ভাষায় শরীরের অব্যক্ত যন্ত্রনা বুঝে ওঠার এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গী তার আরও একটা মহৎ গুন।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এবার আসি,রান্নাঘরে কাজ আছে এই বলে করবী রুম থেকে বেরিয়ে গেল।পরমার্থর বুঝতে কিছুই বাকি রইলো না।তার বাবা-মাকে সে ভালোকরে চেনে,বদমেজাজী দুজনেই ,শুধু একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা’র প্রতি কর্তব্য অবহেলা করবে না এই মানসিকতায় অফিসের এত সুন্দর ফ্ল্যাট পাওয়া সত্বেও সে করবীকে নিয়ে সেপারেট ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠেনি।
দুদিন আগেই করবীদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে তারা দুজনে।করবী অনেক ইতস্তত করে তার মাকে এ বাড়ির কথা বলতেই মা বললেন- থাক ওসব কথা,তোমায় উচ্চশিক্ষিত করেছি মা, সব পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্যই।শ্বশুরবাড়িতে সব মেয়েদেরই একটু- আধটু এরকম পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে হয় মা, পরমার্থ তো তোমার প্রতি উদাসীন,এটাও কত মেয়ের কপালে থাকেনা।এ কথাটা পরমার্থর কানে ভেসে এল, কারণ সেসময় ও ঘর থেকে ফোন হাতে করবীকে দিতে আসছিল সে এ ঘরে,করবীর একটা ফোন এসেছিল,থমকে গেল পরমার্থ ,করবীর মায়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর নিজের বাবা-মা’র দুর্ব্যবহারের লজ্জায় মাথা নীচু হওয়ার স্তব্ধতা।পারিবারিক শিক্ষা জীবনকে নতুন আলোর সন্ধান দেয়, বাঁচার রসদ জোগায়।এ ঘটনা আজ খুব মনে পড়ে গেল তার, একতরফা মানিয়ে নিতে নিতে একটা পরিণত মনের মৃত্যু হয়,সে যন্ত্রনা সইবার ক্ষমতা আমার নেই।কিছু একটা পন্থা আমায় বের করতেই হবে করবীকে সম্মানের সাথে বাঁচার জন্য।স্বামী হিসেবে এটা আমায় করতেই হবে ,তারপর অফিসের কাজে কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত ।
রাতে ডিনার সেরে যথারীতি নিজের শোবার ঘরে ঢুকে করবীকে বুকের কাছে টেনে নিল ,বললো আমার একটা কথা রাখবে তুমি?আমি চাই আমি একটা সংস্থা ওপেন করবো তার সব দায়িত্ব সেখানে থেকে তুমি পালন করবে,কত অসহায় মানুষ অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে আছে তাদের পাশে থাকার আলাদা আনন্দ,আমি জানি তুমি তা খুব ভালো করে সামলাতে পারবে।আমার বাবা -মাকে নিয়ে ভেবো না আমি ওনাদের ঠিক সামলে নিতে পারব। করবী বাকরুদ্ধ ,পরমার্থ বললো-দেখো করবী,মেয়ে নামক এক অভিশাপে সমাজের অনেক করবী অকালে ঝরে যায় ।প্রথমে কন্যা,তারপর সহধর্মিনী থেকে মা হয়ে ওঠার শাশ্বত মায়া –সমাজ তোমাদের দুর্বল ভেবে একটা গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখতে চায় ,নিজেদের বিলিয়ে কত স্বপ্নের আকালবোধন হয় প্রতিনিয়ত।তোমাদের প্রতি অবহেলার বিরুদ্ধে এক আত্মমর্যাদার নাম হোক–নারী।চিরাচরিত প্রথা থেকে বেরিয়ে সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে বারবার–নারী মানে সংগ্রামী সুখ ছিনিয়ে নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প,যা শত শত রুগ্ন কুঁড়িকে বিকশিত হওয়ার সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাবে।আত্মনির্ভরশীলতা শক্তির সহায়তায় কর্মের বৃহত্তর পরিধিতে সাফল্যের শীর্ষ সোপানে পুরুষদের সমকক্ষ হওয়ার অধিকারের জয়টিকা পরতে হবে। পারবে না?আমি তোমার পাশে সবসময় থাকব ।করবীর চোখে আনন্দের অশ্রু ,মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত–’আমি তোমার ও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ’…..
মোনালিসা নায়েক
আরামবাগ
হুগলী
পশ্চিমবাংলা
ভারত