আরামবাগের মানুষ হিসেবে আমাদের গর্ব যে, রামমোহন, রামকৃষ্ণদেবের মতো বিদ্যাসাগরেরও জন্মভূমি আমাদের এই আরামবাগ মহকুমায় । সমস্ত বাঙালিকে আমরা জানাতে চাই , বিদ্যাসাগর কীভাবে কেন আসলে
আরামবাগেরই মানুষ ছিলেন ।
আরামবাগ মহকুমার এক ছোট্ট গ্রাম বনমালীপুর । এই গ্রামেই বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষদের বাস । বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাসেরও জন্ম এই গ্রামেই । ঠাকুরদাসের পিতা মানে বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝেমধ্যেই বিবাগী হয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে যেতেন । সে সময় তাঁর স্মৃতিভ্রংশ হয় এবং স্মৃতি ফিরে পেলে তিনি আবার বাড়ি ফিরে আসতেন । এরকমই একবার রামজয় গৃহত্যাগী হন এবং ঘর সংসার ভুলে গিয়েছিলেন । তাঁর স্ত্রী দুর্গামণি এই সময় বাড়ির অন্য সদস্যের কাছ থেকে নিরন্তর গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি বীরসিংহে চলে যান। রামজয়ের যখন স্মৃতি ফিরে আসে তখন বাড়ি ফিরে স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে না পেয়ে তিনিও শ্বশুরবাড়ি বীরসিংহ চলে যান । সেখানেই তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দেন । এই গ্রাম থেকেই ঠাকুরদাসের সঙ্গে ভগবতীর বিয়ে হয় এবং সেই কারণেই ঈশ্বরচন্দ্রেরও জন্ম হয় এই বীরসিংহ গ্রামে । বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয় স্ত্রীর পথ অনুসরণ করে যদি বীরসিংহে উঠে যেতে বাধ্য না হতেন তাহলে আরামবাগের এই বনমালীপুরই হত বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি । তবুও বলব , তিনি এই আরামবাগ মহকুমাতেই জন্মেছিলেন । কারণ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ( ১২ আশ্বিন ১২২৭) বিদ্যাসাগর যখন বীরসিংহে জন্মগ্রহণ করেন সে সময় বীরসিংহ ছিল আরামবাগ মহকুমাতেই । তখন অবশ্য আরামবাগের নাম ছিল জাহানাবাদ । ১৮৭২ খিস্টাব্দে অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের বয়স যখন বাহান্ন বছর তখন বীরসিংহ আরামবাগ মহকুমা থেকে মেদিনীপুরে চলে যায় । তার মানে জীবনের একাত্তর বছরের মধ্যে বাহান্ন বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ছিলেন আরামবাগেরই মানুষ । শুধু তাই নয়, যেদিন থেকে বীরসিংহ মেদিনীপুরে চলে যায় সেদিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিদ্যাসাগর এক রাতও কাটাননি মেদিনীপুরি বীরসিংহে।
বিদ্যাসাগরের মামার বাড়ি আরামবাগ মহকুমার গোঘাট গ্রামে । তাঁর শ্বশুরবাড়ি ক্ষীরপাই তখন ছিল এই আরামবাগ মহকুমাতেই । তাঁর মায়ের মামার বাড়ি আরামবাগ মহকুমার পাতুল গ্রামে । এই পাতুল গ্রাম থেকেই তাঁর মা ভগবতী দেবীর বিয়ে হয় ঠাকুরদাসের সঙ্গে । গোঘাটের বদলে পাতুল থেকে ভগবতীর বিয়ে হওয়ার কারণ , বিদ্যাসাগরের মাতামহ গোঘাট থেকে উঠে গিয়ে পাতুলে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন । তার মানে বিদ্যাসাগরের পিতামহ ও মাতামহ দুজনেই ঘরজামাই ছিলেন । বিদ্যাসাগর মায়ের মামার বাড়িকে নিজের মামার বাড়ি বলেই মনে করতেন । আরামবাগ মহকুমার এই পাতুল গ্রামের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে । পাতুল গ্রামের অদূরে কৃষ্ণনগর গ্রামের বিধবা ভবসুন্দরীর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একমাত্র পুত্র নারায়ণের বিয়ে হয় ।
তিনি যতগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার অধিকাংশই এই আরামবাগ মহকুমাতে । তাঁর প্রতিষ্ঠিত শেষ বিদ্যালয় (১৮৮৮) খানাকুল কৃষ্ণনগর জ্ঞানদা ইন্সটিটিউট আরামবাগ মহকুমাতেই । এ ছাড়াও তাঁর আরও অনেক মহৎ কীর্তির সঙ্গে আমাদের আরামবাগ মহকুমার নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।
তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে আমরা জানতে পারি, বীরসিংহের সিংহ শিশু বলছি বটে আদতে বিদ্যাসাগর এই আরামবাগেরই মানুষ ছিলেন ।
____
।