আমার বেশ কিছু বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছেন–আমি ত্রিপুরাকাণ্ড নিয়ে কিছু লিখছি না কেন ! আসলে কিছু লেখার প্রবৃত্তিই হচ্ছে না। তার কারণ, ক্রিপুরায় যা হচ্ছে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত বা অভাবনীয় নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের বাছাই নেতানেত্রীরা বহির্বঙ্গের যেখানে যাবেন সেখানেই এমনটাই হবে। উপায়ও নেই কোনো–স্থানীয় এক পিসও গ্রহণযোগ্য কোনো নেতানেত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের নেই–নেই বুথ স্তর তো দূরের কথা জেলা স্তরেও কোনো নির্ভরযোগ্য সংগঠন–সুতরাং কলকাতা থেকে কিছু বাছাই নেতানেত্রী পাঠিয়ে সংগঠনের চাষ করার চেষ্টা করতে হবে। এতে চাপ বাড়বে রপ্তানীকৃত নেতানেত্রীদের ওপর। যেমনটা হচ্ছে ত্রিপুরায়। স্থানীয় নির্ভরযোগ্য ভরসাযোগ্য নেতানেত্রী নেই। তাই ত্রিপুরার একটি থানায় আজ যে টান টান উত্তপ্ত দৃশ্য আমরা দিনভর দেখলাম তা দেখে একটুও কি মনে হচ্ছিল ঐ থানাটি পশ্চিমবঙ্গেরই কোনো থানা নয়? একটি জায়গায় অবশ্য বড়রকমের পার্থক্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কোনো থানায় আইপিএসের টেবিল ঘিরে বসে তর্জনিতুলে হাত-পা ছুঁড়ে বিরোধী দলের নেতারা ধমকাচ্ছেন চমকাচ্ছেন এমন মহামূল্যবান ‘গণতান্ত্রিক’ দৃশ্য কেউ দেখেছেন বলে মনে করতে পারবেন না। প্রশাসনিক হামলা মামলা এবং বিরোধী নেতাদের যথেচ্ছ গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ বিশ্বরেকর্ড তৈরি করে ফেলেছে বললেও বেশি বেশি বলা হবে না। অসংখ্য নজির তুলে ধরা যায়–আমি সে আণোচনায় যাচ্ছি না। আজ সারাদিন ধরে ত্রিপুরার থানা পুলিশ প্রশাসনের ব্যাপারগুলো দেখে যারপরনাই বিস্মিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে–ত্রিপুরা এত তাড়াতাড়ি পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ থানা ও প্রশাসনের ক্লোন তৈরি করে ফেলল কি করে ! ইটের বদলে পাটকেলের নাম রাজনীতি সে তো জানি–কিন্তু থানা-পুলিশের ক্লোনও এত পারফেক্টলি কি করে সম্ভব? অসম্ভব যে নয় তা ত্রিপুরা সরকার দেখিয়ে দিল। তৃণমূলের তরুণতুর্কী সেনাদের ওপর সঙ্ঘটিত হামলা নিশ্চিতভাবেই ধিক্কারযোগ্য। কোনোভাবেই এই হামলাকে সমর্থন করা যায় না। এই হামলার বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বেশ কিছু ভিডিও তৃণমূল কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলবে বলেই আমার মনে হয়েছে। মাথায় আঘাত লাগার কারণে কিনা জানি না–সুদীপ রাহা অদূরের জমায়েতর দিকে তাকিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করলেন তাতে তৃণমূলের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হলেও বাংলার ভাবমূর্তির যথেষ্ট ক্ষতি হল বলে অনেকেই মনে করছেন। যাইহোক, এসব নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভাল। আসল ব্যাপারটা কিন্তু রাজনীতি–এবং তা খুব স্বস্থ্যকর রাজনীতি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ত্রিপুরাতে তৃণমূলকে মাথা তুলতে হলে বিজেপি দলকে ভাঙতে হবে। শুধু বিজেপিকে ভাঙালেই হবে না–সিপিএম-কংগ্রেসকেও ভাঙতে হবে। এই মুহূর্তে তাদের গোটা কয়েক এমএলএ যে ভাবেই হোক চাই। দল ভাঙাভাঙির রাজনীতিতে তৃণমূল ও বিজেপি’র মেধার তুল্যমূল্য বিচারে তাদের অনেক পিছনে থাকতে হচ্ছে বাম-কংগ্রেসকে–তাই ভয়টা তাদেরই বেশি। বিজেপি’র খুব বেশি ভয় পাওয়ার কারণ রয়েছে বলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না। তৃণমূলকে তাই বিজেপি-বাম-কংগ্রেসকে ভাঙার পাশাপাশি স্থানীয় ট্রাইবাল সংগঠনগুলোকেও কাছে টানার চেষ্টা করতে হবে। ত্রিপুরায় বিজেপি’র প্রধান প্রতিপক্ষ এই মুহূর্তে সিপিএম। তারা বিপ্লব দে’র দুর্বল শাসনের কারণেই বেশ খানিকটা মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে্। যদিও সিপিএমের বিজেপি বিরোধিতা খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারবে কিনা তা নিয়েও সংশয় তৈরি হচ্ছে মূলতঃ পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের অন্দরে ‘বিজেমূল’ তত্ত্বের বাদানুবাদের কারণে। সিপিএমের মধ্যে এই তত্ত্বের দৌলতে মতানৈক্য প্রকট হচ্ছে। অনেকেই বলছে–সংশোধনবাদী সিপিএম এখন বিজেমূল তত্ত্ব ছেড়ে ‘তৃণাপিএম’ তত্ত্ব বাজারে আনতে চলেছে–এতে তাদের বিজেপিবিরোধিতার রাজনীতি বেশ জোরদার হতে পারে ! একদিকে তৃণমূলের ‘ঘর গোছানো দল ভাঙানো’ রাজনীতি এবং অন্যদিকে ত্রিপুরায় ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সিপিএমের তাগিদ এবং ত্রিপুরায় কংগ্রেসের সাইনবোর্ড বাঁচানোর রাজনীতির লড়াই থেকে বিজেপি-ই রাজনৈতিক সুবিধে না পেয়ে যায়–এটাই সিপিএমের বিষম মাথাব্যথার কারণ। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার মতো ত্রিপুরা বিধানসভাতেও তারা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে নির্মূল হতে চাইবে না কিছুতেই। সিপিএমের এই জোরালো রণনীতিই বিজেপি বিরোধী ভোটকে অনেকটাই কাটাকাটির সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। গ্রাউণ্ড লেভেলে সংগঠন গড়ে তোলার মতো স্পেস তৃণমূলকে বিজেপি তো বটেই–সিপিএমও দেবে না। পশ্চিমবঙ্গে তারা যে শিক্ষা পেয়েছে তা ত্রিপুরাতে তারা পেতে চায় না। সুতরাং ত্রিপুরাতে যারা ‘হরিনাম খাবলা খাবলা’ মনে করছে তাদের খোল ফেঁসে যেতেই পারে। জল সবে গড়াতে শুরু করেছে–সিপিএমের কলকাতা টিম এবং পলিটব্যুরোর টিম ত্রিপুরাতে পা রাখে নি–তারা এখনও ছ’মাস জল মাপতেই ব্যস্ত থাকবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে সিপিএম–এক ইঞ্চি স্পেসও তারা কাউকেই ছাড়বে না–এটা এখন থেকেই নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে !!