মুরারি মোহন চক্রবর্তী :
মাতৃভাষা অর্থাৎ মা’য়ের মুখের ভাষা,যা সকলের ভালোবাসার ও জন্মগত অধিকারের ভাষা।
ভাষা আন্দোলন বলতে, মাতৃভাষা যখন বিপন্ন হয়, দৈনন্দিন কাজ কর্মে মনের ভাব ব্যক্ত
করার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার যখন ক্ষুন্ন হয়, বিপরীতে অন্যভাষা চাপিয়ে
দেওয়া হয় তখনই রক্ষা করার প্রশ্ন উঠে আসে, গড়ে ওঠে আন্দোলন, তাকেই ভাষা
আন্দোলন বলতে পারি। এই প্রকার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ত্যাগ, ও জীবন দিয়ে
যারা শহিদ হয়েছেন তঁদের কথা, বাংলা ভাষা আন্দোলন কোথায় কোথায় হয়েছে, কী ছিল
তার প্রকৃত কারণ? এ সবকিছু না জানলে, সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে মাতৃভাষার বর্তমান
সমস্যার কথায় নীরব থেকে আন্দোলনের প্রতি ও শহিদ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো কী
ভাবে সম্ভব?
মাতৃভাষা বলতে এখানে বাংলাভাষা প্রসঙ্গে কিছু কথার শুরুতেই জানাতে চাই; বাংলা
ভাষাই আমাদের বাঙালি জাতির পরিচয় দিয়েছে, যা আমাদের গর্বের বিষয়। ভাষাবিজ্ঞানী-
ভাষাগবেষক শ্রদ্ধেয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ‘আমরা হিন্দু-মুসলমান যেমন সত্য,
তেমনই সত্য আমরা বাঙালি’।
এবার আসা যাক আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনের জানা না জানা
কথায়। বাংলাভাষার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান আন্দোলনের কথা বিশেষ করে সকল ভাষাপ্রেমী
বাঙালির জেনে রাখা ভালো, তবুও অনেকে জানেন না। বিপরীতে যারা জানতে চেষ্টা
করেছেন তাঁরা অবশ্যই জানেন। উল্লেখযোগ্য তিনটি আন্দোলনের মধ্যে
- প্রথমটি, মানভূম ভূখ-ে বাংলা ভাষার অধিকার ও মানভূম অঞ্চলকে বঙ্গভুক্তির দাবিতে
আন্দোলন। - দ্বিতীয়, বাংলাভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দু বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন,
ঢাকা-বর্তমান বাংলাদেশ। - তৃতীয়, বাংলাভাষা তুলে দিয়ে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন,
শিলচর-আসাম। প্রত্যেকটি ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি সমতা লক্ষ্য করা যায় যেমন, - সরকারের জনবিরোধী চিন্তা, বাংলা ও বাঙালিকে দুর্বল করে তুলতে বলপ্রয়োগ করে
বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত। - বিপরীতে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে মাতৃভাষাপ্রেমী জনগণের ঐক্যবদ্ধ অনঢ় অবস্থান ও
আন্দোলন।
আজ আলোচনার বিষয়, মানভূম অঞ্চলের আন্দোলন। এই আন্দোলনের অবস্থা বুঝতে হলে
শুরুর সময়ের কিছু কথা জানতে হবে। সময়টা ছিল ১৯১১-১৯১২ সাল, ইংরেজ শাসনাধীন
পরাধীন অখন্ড ভারত।
বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সমস্ত অঞ্চল নিয়ে একটি প্রদেশ ছিল। এই প্রদেশ থেকে বিহার ও
উড়িষ্যাকে একত্রে রেখে বাংলাকে একটি পৃথক রাজ্য করা হলো। বাংলার একটি অংশ
মানভূম অঞ্চলকে তখন বাংলা থেকে কেটে নিয়ে নবগঠিত বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশর বিহারের
অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হলো। এই অবস্থায় বাঙালি প্রধান মানভূম-এর মানুষ তা মেনে নিতে
চাইলনা। চাইবেই বা কেনো, যে হেতু মানভূম বাংলারই অংশ। কিন্তু তাদের না চাওয়াকে
গুরুত্ব না দিয়ে ইংরেজ সরকার সিদ্ধান্ত বহাল রাখলো। যদিও আন্দোলনের চাপে ১৯১১
সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদ করা হলেও মানভূম-এর প্রশ্নে তা হলোনা। আন্দোলনের সূত্রপাত এখান
থেকেই।
মাতৃভাষার টানে জনসাধারণের মনে দাবিগুলি বেঁচে থেকে শক্ত ও প্রবল হতে থাকল,
বিপরীতে কোন প্রকার গুরুত্বই দিতে চাইলনা সরকার। ধীরে ধীরে আন্দোলনের ভাবনার
প্রসার ঘটতে থাকল। ১৯৩৫ সালে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে গড়ে উঠলো- ‘মানভূম
বিহারী সমিতি’। তখন সারাদেশে ইংরাজ বিরোধী আন্দোলন চলছে। মানভূমের বাঙালিরাও
পিছিয়ে ছিলনা। তারাও ঐক্যবদ্ধভাবে প্রখ্যাত বাঙালি ব্যারিস্টার পি. আর দাশকে সভাপতি
করে ‘মানভূম সমিতি’ গঠন করলো। পি.আর দাশ হলেন, অন্যতম খ্যাতনামা ব্যারিস্টার চিত্ত
রঞ্জন দাশের ভ্রাতা। মানভূম সমিতি গঠন করার পরে সতীশ চন্দ্র সিংহ একটি প্রস্তাব
উত্থাপন করলেন তাহলো এই, রাঁচী, পালামৌ, সিংভুম ও মানভূম নিয়ে ছোট নাগপুর নামে
একটি প্রদেশ গঠন করে বাংলার সাথে যুক্ত করা হোক। এই প্রস্তাবটি সমর্থনযোগ্য মনে
করেনি কেউ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কয়েকজন বিহারী মানভূমকে বিহারে যুক্ত করার বিরোধিতা
করেছিলেন। তাঁরা হলেন, ড. সচ্চিদানন্দ সিং, দীপনারায়ণ সিংহ, পরমেশ্বর লাম, মহম্মদ
ফকুরুদ্দিন ও নন্দকিশোর লাল। দীপনারায়ণ সিংহ পরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৩৫ সালে বিহার থেকে পৃথক করে উড়িষ্যাকে একটি নতুন প্রদেশ
করা হলো। ভাষা আন্দোলনের ভাবনা তবুও থেমে গেলনা, একইভাবে চলতে থাকলো।
দেশ স্বাধীন হলো, তবে ভাষা আন্দোলনের সমাধান হলোনা। ১৯৪৮ সাল, বিহারে তখন
কংগ্রেস সরকার, মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। আন্দোলন তীব্ররূপে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
বিহার পুলিশের অমানবিক দমন পীড়ন নেমে এলো। সরকারি নির্দেশ জারি হলো, রাজ্যের
ভাষা হিন্দি, হিন্দি ভাষাতেই পঠন পাঠন চলবে। বাংলা বিদ্যালয় গুলিতে হিন্দি বাধ্যতামূলক
করা হতে লাগলো। হিন্দি শিক্ষক নিয়োগ করা হলো নতুন করে। বাংলা ভাষাভাষী এলাকায়
হিন্দি মাধ্যম বিদ্যায় গড়ে তোলা হতে লাগলো। দোকানের সাইন বোর্ডও হিন্দিতে লেখা শুরু
হয়ে গেলো। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারাবরণ করতে হলো অসংখ্য বাংলাভাষাপ্রেমী
মানুষকে। পুলিশের দমন পীড়নের মধ্যে কংগ্রেস দলও নীরব থাকলো এই অবস্থায়
কংগ্রেসের জেলা কমিটির ৩৩জন সদস্য দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে শ্রদ্ধেয় অতুলচন্দ্র ঘোষের
নেতৃত্বে ‘লোক সেবক সংঘ’ নামে একটি দল গঠন করলেন। এই দলে যুক্ত হলেন
জেলাস্তরের অরুণ চন্দ্র ঘোষ, রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন, গুণেন্দ্রনাথ রায়,
লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, বিভূতি ভুষণ দাশগুপ্ত, ভাবিনি মাহাতো, ভজহরি মাহাতোসহ আরও
অনেকে। ১৯৪৮ সাল থেকে সমাজের অনেক সংখ্যক বিশিষ্টজন, সাধারণ মানুষ এই
আন্দোলনে যুক্ত হতে এগিয়ে এলেন। ঠিক এইরকম অবস্থায় ও সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে ভাষা
আন্দোলন শুরু হতে থাকে। যেমন মহারাষ্ট্রে গুজরাটি ভাষার মানুষের আন্দোলন, মাদ্রাজে
অন্ধ্র প্রদেশ গঠনের(তেলেগু) দাবিতে আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সে সময় পাকিস্তান সরকার সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের
উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে সোচ্চার দাবি জানিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপক্ষে
দুর্দান্ত আন্দোলন গড়ে উঠলো। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আন্দোলনের পরে ২১
ফেব্রুয়ারি সেখানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পেলো। কিন্তু সার্বিক সফলতা অর্জনের বিষয়টি
গুরুত্ব সহকারে অর্জিত হলো না। তারই সূত্র ধরে শুরু হলো মাতৃভূমি বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। অনেক রক্ত ও প্রাণের, ত্যাগের বিনিময়ে ৬৯এর গণ
অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখ-ের
বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে মাতৃভাষা
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলো। সরকার বদল হলেও বাঙালির
মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পরিপন্থি কোন কার্যক্রম বাংলাদেশে হয়নি। বাংলা তথা
মাতৃভাষার জন্য বাঙালির এই আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়ে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা বিশ^মাঝে সমাদৃত হলো। শুধু বাঙালির জাতীয় ভাষা দিবস নয়।
ইউনেস্কোর (টঘঊঝঈঙ) কল্যাণে সমগ্র বিশ্বে (জাতিসংঘ ভুক্ত ১৯৪টি দেশে) প্রতিবছর
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। বিশ্বে সমগ্র ভাষার
মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান চতৃর্থ হলেও বিশ্বের প্রায় ৪ হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে
অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে। বাংলাই একমাত্র ভাষা যা ভাষার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জন্ম
দিয়েছে। ভাষা দিবসের এই বিশ্ব অভিষেক, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে শহীদের আত্মত্যাগ
সর্বাংগে সার্থক হয়েছে। এই আনন্দ, এই সুখ, এই শান্তি -প্রকাশে অব্যক্ত খুশিতে ভরপুর
আমাদের হৃদয় মন এবং উচ্ছ্বসিত আনন্দে উদ্বেল আমরা। এ এক বিশাল ইতিহাস। কিন্তু
মাতৃভাষা আন্দোলনের শহিদ ও ভাষা সৈনিকদের সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা ভূক্ত
করতে পারেনি এটাও চিরন্তন সত্যি।
অন্ধ্র প্রদেশের দাবিতে ৫৮ দিন অনশন করে ৫২ সালে ১৫ই ডিসেম্বর পোত্তি শ্রী রামুলু
শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে মাতৃভাষা ভিত্তিক আন্দোলন একটা নতুন শক্তি পেলো।
জনগণের চাহিদাকে চাপা দিতে না পেরে সরকার তখন রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করতে
বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালে কে এম পরিক্কর, সৈয়দ ফজল আলী, হৃদয়নাথ কুঞ্জুরা এই তিন
সদস্যের একটি কমিশন গঠন করা হলো। এই সময় পশ্চিম বাংলা ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী,
দুজনের অংশ গ্রহণে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হলো পাটনায়। বাংলার মানুষ
ও আন্দোলনকারী আশার আলো দেখলেও কার্যত তা হলোনা। বৈঠকের শেষে ড. বিধান
চন্দ্র রায় বললেন, অত্যাচারের পীড়নের সব অভিযোগ সঠিক নয়, যা কিছু প্রমাণিত হয়েছে,
বিহার সরকার তার ব্যবস্থা করবে। আন্দোলনকারীরা তবুও আশাহত হলোনা। দুই রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রীদ্বয় আবার একটি প্রস্তাব নিয়ে এলেন। বলা হলো দুটি রাজ্যকে একত্রে যুক্ত করে
পূর্বপ্রদেশ নামে একটি রাজ্য করা হোক। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ
হয়ে প্রতিবাদে পথে নামলো। কিন্তু বিহার বিধান সভায় এই প্রস্তাব পাশ করাও হলো।
বাংলা-বিহার উভয় রাজ্যের মানুষ প্রস্তাবটি মেনে নিতে রাজি হয়নি। আন্দোলন চলাকালীন
৭৩ বছর বয়স্ক অসুস্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রদ্ধেয় অতুল চন্দ্র ঘোষকে প্রবল শীতের মধ্যে
পুরুলিয়া জেল থেকে খোলা ট্রাকে ১৫৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাজারিবাগ জেলে নিয়ে
যাওয়া হয়। সাংসদ ভজহরি মাহাতোকে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা
হয়। এই আন্দোলনে বেশ কিছু পত্র পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন,
মুক্তি-মর্মবাণী-কল্যাণ বার্তা-পল্লী সেবক-তপোবন-অগ্রগামী- হিন্দিভাষায় প্রগতি-নির্মাণ-
জনসেবক ইত্যাদি।
অতুল চন্দ্র গুপ্ত, ডক্টর প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ-এর মতো বিশিষ্টজনেরাও সরকারের ভ্রান্ত
সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করে বাঙালি প্রধান মানভূম জেলা বঙ্গভুক্তির দাবিকে জোরালো
সমর্থন করলেন। দুই মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ও মানভূমকে বঙ্গভুক্ত করার দাবিতে
মানভূম জেলার জামতড়া অঞ্চলে দশ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে অতুল চন্দ্র ঘোষের
নেতৃত্বে এক জনসভা করা হয়। এদিকে কলকাতায় সেনেট হলেও একটি সভায় বৈজ্ঞানিক
মেঘনাদ সাহা, জ্যোতি বসু, কাজী আবদুল আয়াদুদ, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, গোপাল হালদার
প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনের দাবির সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। প্রথম দিকে না থাকলেও পরে
বামপন্থীরা আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান।
১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল ১৫০০ অধিক পুরুষ ও মহিলাপুঞ্চার পাক বিররা গ্রাম থেকে পদ
যাত্রা শুরু করে ১৬ দিন পরে ৬ই মে কলকাতায় এসে পদযাত্রার সমাপ্তি করে। বাসন্তী
রায়ের নেতৃত্বে ৩৫০ জন মহিলা এই পদ যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলো। কলকাতার অসংখ্য
মানুষ আন্দোলনকারীদের ফুল-মালা দিয়ে স্বাগত জানাতে এসেছিল। ময়দানে অতুল চন্দ্র
ঘোষের নেতৃত্বে আয়োজিত জনসভায় কলকাতার সাধারণ মানুষ দলে দলে যোগদান করে
সভায় অংশগ্রহণও করেছিলো।
হেমন্ত কুমার, মোহিত মৈত্র, জ্যোতি বসু, সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অংশগ্রহণ করে
বক্তব্য রাখেন। ৬ই মে চূড়ান্ত সাফল্যের পরে ৭ই মে ডালহৌসিতে আবার সভা করতে
চাইলে কংগ্রেস সরকার সম্মতি দেয়নি। তখন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। আগ্রহীরা
উদ্যোগ নিলে ৯৫৬ জনকে গ্রেফতার করে সভা বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। সারা বাংলায় তখন
৩৩০০ জনকে আটক করা হয়েছিলো। এই সময় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ
করলে দেখা যায়, মানভূম জেলার ১৯টি থানা এলাকা নিয়ে পুরুলিয়া নামে একটি নতুন
জেলা গঠন করে বঙ্গ ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু ১৯টি থানার মধ্যে তিনটি থানা
এলাকার ভাগ্য নির্ধারিত হলো জে আর ডি টাটা এবং মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের মধ্যে
একটা রুদ্ধদ্বারকক্ষে আলোচনার মাধ্যমে। কী সেই আলোচ্য বিষয়, তা জানা যায়নি। শেষ
পর্যন্ত তিনটি থানা বিহারে রেখে দিয়ে বাকি ১৬টি থানা নিয়ে নব গঠিত পুরুলিয়া জেলাকে
পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করা হলো, ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর তারিখে। অতুল চন্দ্র ঘোষ ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের এক কর্মী এবং মানভূমি বাংলা ভাষা আন্দোলনের মুখ্য নায়ক।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই ভাষা আন্দোলন, দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষা জাতিগত পরিচয় বহন করে। মাতৃভাষা না থাকলে
আত্মপরিচয়হীন যাযাবর গোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকেনা। তাই আমাদের
দায়িত্ব মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা ও ভালোবেসে সচেতনভাবে চর্চা করা। অন্যভাষা শিখতে
দোষ নেই, মাতৃভাষাকে তুচ্ছ না করে ছোট না ভেবে। মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা না করে
আন্দোলনকারীদের কথা না জেনে, চিহ্নিত কয়কটা দিনে প্রকৃত শ্রদ্ধা কাউকে জানানো
যায়না।
তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকারঃ * ভাষা আন্দোলনে মানভূৃম/ নন্দদুলাল আচার্য - বিভিন্ন সময়ের পত্র পত্রিকা (নিজস্ব সংগ্রহ) লেখক: সব্যসাচী, সম্পাদক ও গবেষক, হুগলি, ভারত।