Arambagh Times
কাউকে ছাড়ে না

একটা সময় ছিল যখন হাতে কোনও নতুন বই এলে তার পাতার অদ্ভুত গন্ধে শেষ লাইন না পড়া পর্যন্ত নেশা কাটত না। আজকাল অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, বই পড়ার অভ্যাস বলুন আর নেশা বলুন,সেটা আমরা প্রায় হারাতে বসেছি। এই তো সেদিন পর্যন্ত এই অভ্যাস বা নেশা পুরোমাত্রায় ছিল। বলতে গেলে, বই ছিল মানুষের অবসরের নিত্য সঙ্গী, সুখে দুঃখে আনন্দে বিষাদে ছিল প্রকৃত বন্ধু। গৃহের নির্জন পরিবেশ ছাড়াও প্রকাশ্য স্থানে, যেমন পার্কে, রেল স্টেশনে, বিমানবন্দরে, দূরপাল্লার ভ্রমণে অনেককেই দেখা যেত, প্রিয় বইয়ের পাতায় নিমগ্ন থাকতে। এখন বাড়িতেই বলুন আর প্রকাশ্য স্থানেই বলুন অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রিয় বইয়ের জায়গা নিয়েছে রঙচংয়ে, ঝকঝকে পত্রপত্রিকা; আর তাও আবার হাতে নিয়ে দু-চারটে পাতা উল্টে এখানে ওখানে কিছুটা পড়ে নিয়ে পাশে রেখে দেওয়া।
আজকের ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট, ই-বুক, ই-ম্যাগাজিন, সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার যুগে প্রায় সব কিছুই যখন হাতের মুঠোয়, তখন অনেকেই বলবেন, বই পড়ার অভ্যাসটা ক্রমশ হারিয়ে ফেলাই তো স্বাভাবিক। তাই তো পড়ার অভ্যাস কিছুটা হলেও, ফিরিয়ে আনতে, বই পড়াকে আবার জনপ্রিয় করে তুলতে আজকাল অধিকাংশ সাহিত্য উৎসবে, বই মেলায় একটি বিশেষ সময় নির্ধারিত থাকে পুস্তক পাঠের জন্য,যার নাম দেওয়া হয় Book Reading Session।
প্রকৃতই বই পড়ার অভ্যাস বা বইয়ের চাহিদা কমে গেছে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এ বছর বিশ্ব পুস্তক দিবস উপলক্ষ্যে কিছু নামি দামি প্রকাশন সংস্থা ও কয়েকজন লেখক লেখিকার মতামত চাওয়া হল। তাঁদের অধিকাংশেরই বক্তব্য, বিশেষ করে, ভারতীয় পাঠক সমাজে প্রিন্টেড বুক’এর কদর এখনও আগের মতই বিদ্যমান। তাই তো আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়া’র আধিপত্য সত্ত্বেও মুদ্রিত বইয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। অনেকের মতে, সোশ্যাল মিডিয়া মুদ্রিত বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করছে। এমনই অভিমত ব্যক্ত করলেন এক বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থার জনৈক আধিকারিক। সোশ্যাল মিডিয়া’ বই বিপণনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে অনায়াসেই পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে। এর আর একটা বড় সুবিধা হল-এই মাধ্যমকে ব্যবহার ক’রে পাঠক ও রচনাকার সরাসরি মতামত বিনিময় করতে পারছেন।
বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে সোশ্যাল মিডিয়া’কে ব্যবহার ক’রে ভারতের বিভিন্ন শহরে নানা সংস্থা গড়ে উঠেছে। আর এই সব সংস্থা নিজ নিজ পদ্ধতিতে পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এমনই একটি সংস্থার নাম Institute for the Study of Texts (IST)। এই সংস্থা READERS’ BREAK নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে,যেখানে অন-লাইনে জন সমীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত বই নিয়ে প্রতি সপ্তাহান্তে আলোচনার আসর বসে।
বই পড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকার প্রশ্নই যখন উঠল তখন দিল্লি মেট্রো রেলের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করেই বা থাকা যায় কি করে! এখানে বই পড়ার এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠছে যা প্রকৃত অর্থেই অভিনবত্বের দাবি রাখে। দিল্লি মেট্রোকে ঘিরে বই প্রেমীর একটা গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যাদের বিশ্বাস sharing-is-caring-এই আদর্শে। তাই মেট্রোয় যাতায়াতের সময় যদি কোনও স্টিকার লাগানো বই দেখতে পান, তা হলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সেটা সঙ্গে নিয়ে যান। মনে করুন বইটা আপনার জন্যই রাখা আছে। এ আপনার সঙ্গ চাইছে,নতুন একটা শান্ত নির্জন গৃহকোণ চাইছে। বাড়ি নিয়ে যান,পড়ুন। এর পর যে কোনও মেট্রো স্টেশনে এটি রেখে যান। আর যেটা অবশ্যই করবেন, তা হল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম অথবা ট্যুইটার-এর মতো সোশ্যাল মিডিয়ার যে কোনও মাধ্যম ব্যবহার করে জানিয়ে দিন।
বই পড়া নিয়ে এই আলোচনায় বর্তমান প্রজন্মকে অবহিত করতেই অতীত দিনের কিছু স্মৃতি রোমন্থনের প্রয়োজন কি উপেক্ষা করা যায়! একটা সময় ছিল যখন, স্কুল জীবনে পাঠ্যসূচির বাইরে অন্য কোনও বই পড়া অভিভাবকদের চোখে অপরাধ বলে গণ্য হত। ১৯ শতকের বাংলায় অবিবাহিত মেয়েদের একান্তে বই পড়া বাড়ির বয়স্কদের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ হিসেবে,এক ধরণের বিদ্রোহী আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হত। গল্পে, উপন্যাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। । আবার বিশেষ করে, গ্রামে ছোটবেলা কেটেছে এমন বয়স্কদের মধ্যে অনেকেরই মনে আছে, দুপুরের রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে সন্ধ্যায় আবার সে দিনের শেষ পর্বের রান্নার আগে যেটুকু সময় মিলত তাতে বাড়ির জ্যেঠিমা,মা,কাকিমাদের, বেশিরভাগকে শরৎচন্দ্র, পড়তে দেখা যেত। তা শোনার জন্য আশপাশের বাড়ি থেকে বয়ষ্করা আসতেন। পাঠক একজন, শ্রোতা বাকীজন। শরৎচন্দ্রই তাঁদের কাছে এত প্রিয় কেন! কারণ খুঁজতে দেরি হয় না। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে বর্ণিত নারী চরিত্র তো তাঁদের একান্ত কাছের মানুষ; যেন তাঁদেরই মধ্যে একজন। চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কখনও ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, কখনও সহমর্মিতায় ভরা দীর্ঘশ্বাস, আবার কখনও চাপা কান্না, আঁচলের প্রান্ত দিয়ে চোখ মোছা- এই ধরণের দৃশ্য প্রায়শই চোখে পড়ত। শিশু মনেও তার একটা প্রভাব পড়ত বৈকি। সে সব এখন ইতিহাস,ধূসর স্মৃতি। সাধারণ মানুষের এই ‘বই বিমুখতা’ র কারন অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়াকে অনেকেই দায়ী করছেন। তবে সুস্থ মানসিকতার জন্য বই পড়া আজও খুবই জরুরি। সৃজনশীলতা, মননশীলতা- এই সব গুনাবলির বিকাশে বই খুবই ভালো বন্ধু।বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই যন্ত্র-নির্ভর সভ্যতায় আজ আমরা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠেছি। এই সব বিচার করে ইউনেস্কো বই পড়ার অভ্যাস বৃদ্ধির জন্য ২৩ শেষ এপ্রিল তারিখ টিকে আন্তর্জাতিক বই দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর ও সুস্থ ভাবে গড়ে তুলতে সবাইকে বইয়ের আশ্রয়ে ফিরতেই হবে। কারণ,বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কবি গুরুর কথায়,”ভালো বই আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।” মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষের পাঠ অভ্যাসের তথ্য পাওয়া যায়। মানুষ বই পড়ে মনের খোরাকের জন্য এবং নিজেকে জ্ঞান আলোয় আলোকিত করার জন্য। জ্ঞানের সূচনা বই থেকেই এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়ে পেয়ে থাকে। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে হতে পারে।এ প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উক্তি মনে পড়ে,” বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে,তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।” এ ক্ষেত্রে আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার জন্য বইয়ের আশ্রয়ে আমাদেরকে ফিরতেই হবে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published.